Monday, September 27, 2010

ধর্মীয় মুখোশে রাজনৈতিক আন্দোলনই হিন্দুত্ববাদ - তপন রায়চৌধুরী

মরা ইংরেজদের ঔপনিবেশিক শাসনের কাছে অনেকগুলি ব্যাপারে ঋণী। তার মধ্যে অন্যতম, রাষ্ট্রব্যবস্থার তিনটি প্রধান খুঁটির পরস্পর ব্যবধান। ইংরেজের অলিখিত সংবিধানের প্রধান ভিত্তি শাসনযন্ত্রের তিনটি প্রধান অঙ্গের পরস্পর স্বাতন্ত্র্য। নির্বাচিত বিধানসভা, নিয়োজিত সরকারি কর্মচারী তথা মন্ত্রিমণ্ডলী আর বিচারব্যবস্থা...প্রত্যেকে স্বাধীন, পরস্পরের কাজে বা অধিকারে হস্তক্ষেপ করে না।
কথাটা সর্বাংশে সত্যি নয়। আইনব্যবস্থা তথা আদালত সংবিধানের ব্যাখ্যা করতে অধিকারপ্রাপ্ত। সেই ব্যাখ্যার মারফত তারা পার্লামেন্টের পরিবর্তিত আইনকে বেআইনি ঘোষণা করতে পারে। কর্মচারী বা মন্ত্রীদের কার্যবিশেষও আইনবিরুদ্ধ হলে নিষেধ করতে পারে। এই সাংবিধানিক আদর্শ ভারতবর্ষ মেনে নিয়েছে।
ভারতীয় রাষ্ট্রের তিন অঙ্গের ভিতরে আইনের আপেক্ষিক প্রাধান্য লক্ষণীয়। সংবিধান ব্যাখ্যা করার চরম অধিকার উচ্চতম আদালত সুপ্রিম কোর্টের হাতে। এই অধিকার সংবিধান এবং নাগরিকদের আস্থার ওপর প্রতিষ্ঠিত। সাম্প্রতিক কিছু সমীক্ষা থেকে আমরা জানতে পারি যে, শতকরা ৭২ জন ভারতীয় আইনব্যবস্থায় আস্থাবান। সে ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীরা শতকরা ৫৬ জনের বিশ্বাসভাজন আর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শতকরা ৪২ জনের। দুর্নীতি আমাদের আদালতগুলিকে স্পর্শ করেছে, তা সত্ত্বেও! তা ছাড়া পর্বতপ্রমাণ মামলা ঝুলে আছে: নিম্ন আদালতে ২ কোটি ৪৮ লক্ষ আর সুপ্রিম কোর্টে সাড়ে ৩৬ লক্ষ।


বজ্রমুষ্টি! অযোধ্যা, ১৯৯২।

সাম্প্রতিক কালে, মানে আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে হিন্দুত্ববাদের ক্ষমতা বাড়ার ফলে রাষ্ট্রজীবনের সঙ্গে ধর্মের সম্পর্ক আমাদের ইতিহাসে একটি প্রধান বিতর্কিত বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বর্তমান বইটি এই প্রসঙ্গে আমাদের উচ্চতম আদালত, সুপ্রিম কোর্টের অবদান বিষয়ে একটি প্রামাণ্য গ্রন্থ। বইটি ‘ল ইন ইণ্ডিয়া’ সিরিজের অন্তর্গত, কিন্তু এটি মূলত আইনবিষয়ক বই মনে করলে ভুল হবে। আমাদের স্বাধীনতা-উত্তর ভারতবর্ষের রাজনীতিক, সামাজিক, বৌদ্ধিক এবং অবশ্যই আইনের ইতিহাসের ক্ষেত্রে এর বক্তব্যগুলির গভীর প্রাসঙ্গিকতা আছে।

Thursday, July 8, 2010

ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারে এত অবহেলা কেন - আহমদ রফিক

বিশেষ করে বিনোদনের এসব মাধ্যম তরুণদের খুবই প্রিয়। স্বভাবতই টিভি’র অনুষ্ঠানে অশুদ্ধ শব্দ ব্যবহার বা ভুল বানান লেখার গুরম্নত্ব অস্বীকার করা চলে না। কিন্ত্ত টিভি পরিচালকগণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, যেমন ঘামান না ‘টক-শো’ বা ‘বিতর্ক অনুষ্ঠানের’ বক্তা। তারা তাদের মত করেই বলেন, যেমন বলেন সংসদ অধিবেশনে সাংসদগণ। তাদের উচ্চারণ শুনলে মাথা ধরে যায়

আমরা বাঙালি। বাংলা আমার মাতৃভাষা। রাষ্ট্রভাষা আমাদের বাংলা।’ বিষয় তিনটে নিয়ে আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর তরম্নণদের মধ্যে গর্ব ও অহংকারের প্রকাশ যথেষ্ট। অবশ্য সঙ্গত কারণে। পাকিস্তানি আমলে অনেক লড়াই করে রাষ্ট্রভাষার অধিকার অর্জন, রীতিমত যুদ্ধ করে অনেক মৃত্যু, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা-এ সবই এখন ইতিহাস। এবং ভাষার প্রতি, জাতীয়তাবোধের প্রতি মমত্বের প্রকাশ।

Thursday, May 27, 2010

কবি ও দার্শনিক - আ. ফ. ম উবায়দুর রহমান

কবির কাজ আবেগ-অনুভূতি নিয়ে আর দার্শনিকের কাজ চিন্তা ও যুক্তি নিয়ে। উভয়েই কিন্তু তাদের স্বস্ব কাজের জন্য বেছে নেন একটি সাধারণ মাধ্যম যা হচ্ছে ভাষা। এই ভাষা ব্যবহার করেন বলেই যিনি কবিতার চর্চা করেন তিনি শিল্পী হয়েও কবি, চিত্রকর নন এবং যিনি দর্শন চর্চা করেন তিনি দার্শনিক, স্থপতি নন। স্থপতি তাঁর কর্মের মাঝে তাঁর দর্শনকে লুকিয়ে রাখেন।, কিন্তুু দার্শনিক তা প্রচার করেন লিখে বা বক্তৃতার মাধ্যমে। কিন্তুু ভাষাটা শুধুই একটি মাধ্যম, কবিতা বা দর্শনের উপকরণ নয়। চিত্রকর বা স্থপতির মত কবি এবং দার্শনিকেরাও বিচিত্র সব উপকরণ নিয়ে কাজ করতে পারেন এবং করেন। সাধারণত: মানুষের আবেগ অনুভূতিকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দেয় যে জিনিষটা তা হচ্ছে প্রেম, আর তাই এটিকেই বেশীর ভাগ কবি তাঁদের কবিতার উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করেন। একই ভাবে জীবন ও জগতের মৌল চরিত্র।

মানুষের চিন্তাকে বেশী উদ্দীপ্ত করে বলে মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যাই দর্শনের মুখ্য আলোচ্যবিষয় বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু কবি বা দার্শনিক কেউ তাদের কাজের পরিধি এ দুটো বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি বা রাখতে পারেননি। কবিতা বা দর্শনের উপজীব্য হিসাবে তাই বিচিত্র সব জিনিষের সমাহার দেখা যায়।অবস্থাটা এখন এমনি যে দার্শনিক এবং কবি উভয়ই তাদের দর্শন এবং কবিতার মাধ্যম যে ভাষা তাকেও তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের কর্মের উপজীব্য হিসাবে নিয়েছেন। আজকাল যাকে আমরা বিশ্লেষনী দর্শন বলি তা মূলত: ভাষা বিষয়ক দর্শন। ভাষার প্রশস্তিতে, বিশেষ করে আমাদের বাংলা ভাষার প্রশস্তিতে লেখা কবিতার সংখ্যা ও নেহায়েত কম নয়।

Friday, May 21, 2010

কালের অগ্নিবীণা -- আহমদ কবির

‘অগ্নিবীণা বাজাও তুমি কেমন করে?’ রবীন্দ্রনাথ তাঁর গানে এ-জিজ্ঞাসাটি কার উদ্দেশে করেছেন জানি না। হয়তো এমনি, কবির স্বাভাবিক অভিব্যক্তি হিসেবে; কিংবা হয়তো তা নয়, মনে হয়তো কোনো শিল্পী ছিলেন। তবে যে শিল্পী নজরুল নন; আর কাব্য নামের জন্য নজরুল রবীন্দ্রনাথের কাছে ঋণী হতে পারেন। নামটি চমৎকার, তাৎপর্যমণ্ডিত ও (প্রতীকময়) নজরুলের স্বভাব, বৈশিষ্ট্য ও কর্মের সঙ্গে দারুণভাবে মানানসই। নজরুল নিজেই তো অগ্নিবীণা। অগ্নিদীপ্ত বাণী ও সুর তো তিনিই। তারই হলকায় পুড়ে যায় ঔপনিবেশিক শাসন-ত্রাসনের আসন। বেজায় বিচলিত ব্রিটিশ সরকার অত্যাচার-নিপীড়নের পথ ধরল, নিষিদ্ধ করল বিশের বাঁশী, ভাঙার গান, প্রলয়-শিখা, যুগবাণী, রুদ্রমঙ্গল—সবগুলোই তো কালের অগ্নিবীণা; সমকালের শোণিতে অগ্নিপ্রবাহ-তীক্ষ� জ্বালাময়, মহাবিস্ফোরক ও অগ্নিউদ্গারী।

নিম্নবর্গ মানুষের সাধক নজরুল - পাবলো শাহি

কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় কোল-মুণ্ডা দেবী চণ্ডী বা চামুণ্ডা শব্দের ব্যবহার এবং এর ব্যুৎপত্তিগত তথ্য ও তাৎপর্য খোঁজা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। বাঙালির রক্তের আলোড়নে প্রথম আদিগান হয়ে উঠেছিল যে 'নিষাদ' জাতি, তা বোধ করি নেগ্রিটো রক্তের সঙ্গে কোল-মুণ্ডা-ভীল-সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আত্মস্বর। নজরুল সেই বাঙালি জাতিসত্তার আদিম এষণার হাত ধরে 'চামুণ্ডা' শব্দের ফাঁদে সাকার ও আকার দিয়ে আমাদের হাজার বছরের ভেসে যাওয়া নাভিচিহ্নকে ধরে দিতে চেয়েছেন। তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণের চৈতন্যে ও ভাব-বস্তুবিশ্বে চণ্ডী, শিব, কালিয়া, কালী এক অভেদাত্দা, যেন তা রুদ্ররূপে চামুণ্ডা শিবের প্রলয়-ঘূর্ণিনাচে আমাদের অন্তর আত্মায় ভস্মীভূত।

নজরুল : একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে - শান্তনু কায়সার

সকলেই জানেন, ১৯৪২ থেকে নজরুলের অসুস্থতার নানা লক্ষণ দেখা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত তিনি মূক হয়ে যান। তারপর থেকে ১৯৭৬-এ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি যেভাবে বেঁচেছিলেন তাকে ঠিক বেঁচে-থাকা একজন কবি ও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বেঁচে থাকা বলে না। নজরুল কি কখনো নিজের ভবিষ্যত আন্দাজ করতে পেরেছিলেন? ১৩৪৩-এ ফরিদপুর জিলা মুসলিম ছাত্র-সম্মিলনে তিনি সভাপতির অভিভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কতদিন মনে করেছি আমার জানাজা পড়া হয়ে গেছে। তাই যারা কোলাহল করে আমায় নিতে আসে মনে হয় তারা নিতে এসেছে আমায় গোরস্তানে – প্রাণের বুলবুলির স্থানে নয়। কতদিক থেকে কত আহ্বান আসে আজও। যত সাদর আহ্বান আসে তত নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলি – ওরে হতভাগা, তোর দাফনের আর দেরি কত? কতদিন আর ফাঁকি দিয়ে জয়ের মালা কুড়িয়ে বেড়াবি?’

সামপ্রতিক বিবেচনা ও নজরুল সংগীত - সাইম রানা

বাংলাদেশে নজরুল জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে তাঁর প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর যত ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়, তা একদিকে কবিকে মর্যাদা দান করে; অন্যদিকে সংস্কৃতিমান মানুষের চর্চার নতুন নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে_এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায়। কবির সৃষ্টিকর্মকে সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া বা তাদের আগ্রহী করে তুলতেও এই সব অনুষ্ঠান বেশ ভূমিকা রাখে।

উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির অবশ্য এ ধরনের আয়োজনের শেষ নেই, কথায় আছে না_বারো মাসে তেরো পার্বণ। ধর্মীয় উৎসব, ফসল ও ঋতু উৎসব, ব্যক্তিজীবনের জন্ম-মৃত্যু উৎসব, কৃত্যানুষ্ঠান_আরো কত কী! এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এবং পরবর্তীকালের চলার ছন্দ খুঁজে নেয়। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর কমতি হয়নি। বরং উদ্যোগের নানা পর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নজরুলকে আরো জানা-বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, সম্প্রতি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এতে নজরুলকে নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ নজরে পড়েছে, যেমন_ছয়-সাত শর মতো স্বরলিপি প্রণয়ন করা হয়েছে, গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে সিডিতে বাজারজাত করা হয়েছে, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গায়কি প্রশিক্ষণ, জাদুঘর নির্মাণ ও রাজধানীর মোড়ে মোড়ে স্মৃতিস্মারকসহ নানা উদ্যোগে নজরুল বেশ শক্ত-সমর্থ হয়ে জাতির সামনে অবস্থান নিয়েছেন।

Thursday, May 20, 2010

বাংলার নবজাগরণের পরম্পরা: নারী জাগৃতির পটভূমিকায় - আবদুল মান্নান সৈয়দ

কল্যাণীয়াসু,

রোজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় আমার- সে যত রাতেই ঘুমোই না কেন? রাতে অনেকদিন ঘুম আসে না। তখন তোমার অনুমোদন নিয়ে ঘুমোই আর দুচোখ জুড়ে আসে। তুমি বোধহয় জাদু জানো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আধো-ঘুমে আধো জাগরণে শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। কত কি মনে আসে। ফেলে আসা জীবনের ছেঁড়া উড়ো স্মৃতির রেণুকণা, দু’একটি পাপড়ি। সে সব দিয়ে মালা গাঁথতে পারবে না। পাপড়ি দিয়ে কি মালা গাঁথা যায়? তার মধ্যেই আমি তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কলম-পেষা মজুর। আজকের দিনে কি কাজ করব- তার একটা আবছা হিসেব থাকে। হিসেবের হেরফের কিন্তু প্রায়ই হয়। সেটা আবার আমার খারাপ লাগে না। ঘরের মুক্তি কিসে?- জানালায়। দরোজায়। আমার মুক্তি ঐ যে হলুদ রোদের ঝলক দেখছি দেয়ালে ঐ অধরা সোনায় সোনায়, ঐ কৃষ্ণচূড়ায় - জারুলে - সোনালুতে - বোগেনভিলিয়ায়, গাছের পাতার রঙ পরিবর্তনে, ঘাসের শ্যামলে, কোনো কোনো হৃদয়ের অন্দরমহলে। করিডোরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। ভোরবেলায় অপরূপ হাওয়া এসে গায়ে লাগে তার সমস্ত মাধুরী নিয়ে। স্নাত হয়ে যায় শরীরাত্মা। আর গভীর করে দেখি দু’একটি উড়ে আসা পাখি। আজ দেখছিলাম একটি শালিক পাখি- কালো বা খয়েরি রঙের মধ্যে যেন মোটা ব্রাশে টানে শাদা রেখা। কী যে অদ্ভুত সুন্দর! আজ যে জন্যে তোমাকে এই চিঠি লিখছি, তা নিষ্কারণে নয়। সেই প্রসঙ্গেই আসি সরাসরি।

Monday, May 17, 2010

“একজন তৃতীয় সারির কবি”: রবীন্দ্রকবিতার বোর্হেসকৃত মূল্যায়ন - রাজু আলাউদ্দিন

রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক-ভাগ্য রীতিমত ঈর্ষণীয় বলা যেতে পারে। জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে ইউরোপীয় ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা লিখেছিলেন এবং তাঁর লেখা অনুবাদও করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখকরা।
—————————————————————–
উজ্জ্বয়িনীপুরের স্বপ্নময় আবেশ, শিপ্রানদীর শিহরণ এবং আরও নানান অনুষঙ্গ উধাও হওয়ার পর যে কংকালটি রয়েছে তা থেকে বিদেশী একজন পাঠক এই কবিতার মহিমা কতটুকু অনুমান করতে পারবেন সেটাই আমার প্রশ্ন।
—————————————————————-
তাদের অনেকেই পরবর্তীতে জয় করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। রুশ ভাষার বরিস পাস্তেরনাক অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ফরাসী ভাষায় ocampo_tagore-1930.jpg…….
বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, প্যারিস ১৯৩০; শেষ দেখা
…….
আঁদ্রে জীদের মতো লেখক। আরও একজন ফরাসী কবি ছিলেন যিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন, তিনি সাঁ ঝ পের্স। যদিও পরে তিনি এই দায়িত্ব অর্পণ করেন আঁদ্রে জীদকে। অন্য একটি ইউরোপীয় ভাষা অর্থাৎ স্প্যানিশে অনুবাদ করেছেন হুয়ান রামোন হিমেনেথের মতো কবি। তিনিও নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না হিমেনেথের সমগ্র রচনার এক তৃতীয়াংশ হলো রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ। স্প্যানিশ ভাষার আরেক লেখক এবং অনুবাদক রাফায়েল কানসিনোস আসসেন্সও অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মানব ধর্ম নামের প্রবন্ধের বইটি। রাফায়েল ছিলেন বোর্হেসের গুরু, যিনি জানতেন ১৪টির মতো ভাষা। এই সব ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করেছেন। কিন্তু যে তথ্যটি আমরা একেবারেই জানি না তাহলো এই যে স্প্যানিশ ভাষার আরেক লেখক যিনি আজ বিশ্বব্যাপী অসাধারণ এক কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ হোর্হে লুইস বোর্হেস, তিনিও রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুবাদ করেছিলেন।

Thursday, May 6, 2010

রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি - সুধা সেন

রবীন্দ্রনাথ এ চিঠিঠি লিখেছিলেন অধ্যাপক সুধা সেনের (১৯১২—১৯৮৩) একটি চিঠি উত্তরে। এ নিয়ে সুধা সেনের একটি অপ্রকাশিত লেখা ছাপা হলো। চিঠিতে ভুলবশত ২৯/৩/২৯ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চিঠিটি ১৯৩৯ সালে লেখা। লেখাটি আমাদের দিয়েছেন সুধা সেনের কন্যা সুনন্দা কবীর।

তখন ব্রিটিশ আমল ও অখণ্ডিত দেশ। আসা-যাওয়া করতে পাসপোর্ট, ভিসা লাগত না। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা মাঝেমধ্যেই পূর্ববঙ্গে আসতেন। তাঁদের সমুজ্জ্বল সংস্কৃতির আলোয় পূর্ববঙ্গ ঝলমল করে উঠত। অবশ্যই পূর্ববঙ্গ কেবল গ্রহণই করত না—শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সংগীতে তারও অবদান কম ছিল না। বিশেষত কুমিল্লা তখন শিক্ষা-সংগীত জগতে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে ছিল। সুরের গুরু আলাউদ্দীন খান, ওস্তাদ খসরু মিঞা, শচীনদেব বর্মণ (যদিও তিনি ত্রিপুরার, কিন্তু কুমিল্লা তখন ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল এবং শচীনদেবের সংগীতচর্চার প্রধান কেন্দ্রই ছিল কুমিল্লা), সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ কুমিল্লারই কৃতী সন্তান। তখন দুই বাংলা এক অচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক বন্ধনে সংযুক্ত ছিল।

বাংলা ১৩৪৫ সনে (খ্রি. ১৯৩৯) কুমিল্লার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে সাহিত্য পরিষদ কুমিল্লা শাখার এক সম্মেলনের আয়োজন হয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সংগীত শাখার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং তাঁরা এই অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে সম্মতিও জানিয়েছেন। স্থান, তারিখ সমস্তই ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়নি শুধু উদ্বোধন সংগীত! ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়া চলবে না। তবে? ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা?’ না, তাও ঠিক উপযুক্ত হবে না।

রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয় - গোলাম মুরশিদ

হিন্দু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ—এ কথা সবাই জানেন। হিন্দু, মুসলমান—সবাই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংগীতের সঙ্গে কোনো পরিচয় থাক, না-ই থাক অথবা যত কমই পরিচয় থাক—মুসলমানরা এটা এত ভালো করে জানেন যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে সারা পৃথিবীতে বাঙালিদের গৌরব বৃদ্ধি করলেও, দীর্ঘকাল তাঁকে নিজেদের কবি বলেই স্বীকার করতে চাননি। এ নিয়ে তর্ক-কুতর্ক সবই হয়েছে সাম্প্রতিক কালেও। কদিন আগে ২ মে শেক্সিপয়ারের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের যে বাড়িতে, সেই বাড়ি দেখে এলাম। তাঁর বাগানে অন্য আর একজন মাত্র বিখ্যাত মানুষের একটি আবক্ষমূর্তি বসানো আছে। সেটি আমাদের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের। ছয় হাজার মাইল দূরের জোড়াসাঁকো থেকে সুদূর স্ট্র্যার্টফোর্ডে চলে এসেছেন। দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠল। কিন্তু একজন সহযাত্রী, যিনি ৪২ বছর বিলেতে আছেন বলে গর্ব করেন, তিনি বললেন, ‘সামনেরবার এসে ওই মূর্তিটা সরিয়ে ওখানে নজরুলের একটি মূর্তি বসিয়ে যাব।’ কাজেই, রবীন্দ্রনাথ অমুসলমান ছিলেন—বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশ এখনো এটা ভুলতে পারেননি।

Monday, April 12, 2010

বাঙালির উৎসব - গোলাম মুরশিদ

এসে গেল আরেকটি নতুন বছর ১৪১৭। এ উপলক্ষে বাঙালির উৎসব নিয়ে লিখেছেন গোলাম মুরশিদ 


বাঙালি, তার মানে, জাতি-ধর্ম-নির্বিশেষে তাবত্ বাঙালি, বারো মাসে তেরো পার্বণ থাকলেও তাঁদের উৎসব বেশি নেই। যা আছে, তার বেশির ভাগ উৎসবই ধর্মীয়, কিছু পারিবারিক। কিন্তু সকল বাঙালি মিলে পালন করতে পারে—এমন উৎসব সত্যি বিরল। অঘ্রাণের শেষে, পৌষের শুরুতে নতুন ধান উঠলে চাষিরা খুশি হতেন, হয়তো একদিন নতুন চালের ভাত একটু আলাদা গুরুত্ব দিয়ে খেতেন। কিন্তু উৎসব হিসেবে এর সঙ্গেও হিন্দু ধর্মের একটা যোগাযোগ ছিল। সুবল মিত্রের অভিধান প্রকাশিত হয় ১৯০০ সালের আগে। তাতে বলা হয়েছে যে আনুষ্ঠানিকভাবে নবান্ন উৎসব পালন না করে নতুন ধানের চাল খাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু তার থেকেও বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন চিন্তাহরণ চক্রবর্তী, ভারতকোষে। তাঁর এই বর্ণনা এখন থেকে বছর পঞ্চাশ আগেকার। তখনই তিনি লিখেছেন, ‘পূর্বে ঘরে ঘরে এই অনুষ্ঠান এবং আনুষঙ্গিক উৎসবের প্রচলন ছিল।’ এ অনুষ্ঠানের বিবরণও দিয়েছেন তিনি। ‘অনুষ্ঠানের মুখ্য অঙ্গ ছিল নূতন চালে পিতৃপুরুষের শ্রাদ্ধ করা।...দেবতা, অগ্নি, কাক, ব্রাহ্মণ ও আত্মীয়স্বজনকে দিয়া গৃহকর্তা ও পরিবারবর্গ আনুষ্ঠানিকভাবে নূতন গুড়সহ নূতন অন্ন গ্রহণ করিতেন। পৌষ সংক্রান্তির দিনও স্বতন্ত্রভাবে গৃহদেবতাকে নবান্ন নিবেদন করিবার প্রথা ছিল।’ তার অর্থ এ অনুষ্ঠানও আধা-ধর্মীয় অনুষ্ঠান। হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৯৩০-৩৪) তাঁর অভিধানে ধর্মীয় অনুষঙ্গ থাকলেও তার প্রতি এত গুরুত্ব দেননি।

মেঘনাদ বধ ও অন্যান্য মহাকাব্য বিচারের ভূমিকা

মো হা ম্ম দ র ফি ক উ জ্জা মা ন

শাস্ত্রকার বিশ্বনাথ কবিরাজ, সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের যে আদর্শ নিরূপণ করেন সে অনুযায়ী মহাকাব্যের লক্ষণগুলো হলো, মহাকাব্যের অন্তত আটটি সর্গ থাকতেই হবে। এক একটি সর্গ একই ছন্দে রচিত হবে এবং সর্গের শেষে ছন্দান্তর ঘটবে! সর্গশেষে পরবর্তী সর্গ সম্পর্কে বর্ণনা থাকবে। প্রতিটি সর্গে বিষয়ানুগ শিরোনাম থাকা আবশ্যক। 'আশীর্ণমস্ক্রিয়া বস্তুনির্দেশনা বহপি তন্মুখম্।' অর্থাৎ মহাকাব্য শুরু হবে আশীর্বাদসহ নমস্কার ও বস্তুনির্দেশনা সহযোগে। 'ইতিহাসকথোদ্ভূতমিতরদ্ধা সদাশ্রয়ম্।' মহাকাব্যের বিষয় ইতিহাসাশ্রিত অথবা সত্য ঘটনানির্ভর হবে। 'চতুর্বর্গকলোপেতং চতুরোদাওনায়কম্।' চতুর্বর্গ ফল, অর্থাৎ ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ ফললাভের উপযোগী এবং নায়ক চতুর উদাত্তগুণসম্পন্ন সদ্বংশজাত। এভাবে মহাকাব্যের ঘটনাক্রমে থাকবে নগর, পর্বত, সমুদ্র, চন্দ্রসূর্যের উদয়, যুদ্ধ, বীরত্ব, মৃত্যু, লোকরঞ্জনসহ বিবাদ, কলহ, প্রতারণা, বিবাহ _ বিচ্ছেদ, মিলন। অলঙ্কার শাস্ত্রের সমস্ত রসাভাষ ও রসাভাস থাকবে মহাকাব্যে। তবে শৃঙ্গার, বীর অথবা শান্তরসের প্রাধান্য থাকবে।