Thursday, May 20, 2010

বাংলার নবজাগরণের পরম্পরা: নারী জাগৃতির পটভূমিকায় - আবদুল মান্নান সৈয়দ

কল্যাণীয়াসু,

রোজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় আমার- সে যত রাতেই ঘুমোই না কেন? রাতে অনেকদিন ঘুম আসে না। তখন তোমার অনুমোদন নিয়ে ঘুমোই আর দুচোখ জুড়ে আসে। তুমি বোধহয় জাদু জানো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আধো-ঘুমে আধো জাগরণে শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। কত কি মনে আসে। ফেলে আসা জীবনের ছেঁড়া উড়ো স্মৃতির রেণুকণা, দু’একটি পাপড়ি। সে সব দিয়ে মালা গাঁথতে পারবে না। পাপড়ি দিয়ে কি মালা গাঁথা যায়? তার মধ্যেই আমি তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কলম-পেষা মজুর। আজকের দিনে কি কাজ করব- তার একটা আবছা হিসেব থাকে। হিসেবের হেরফের কিন্তু প্রায়ই হয়। সেটা আবার আমার খারাপ লাগে না। ঘরের মুক্তি কিসে?- জানালায়। দরোজায়। আমার মুক্তি ঐ যে হলুদ রোদের ঝলক দেখছি দেয়ালে ঐ অধরা সোনায় সোনায়, ঐ কৃষ্ণচূড়ায় - জারুলে - সোনালুতে - বোগেনভিলিয়ায়, গাছের পাতার রঙ পরিবর্তনে, ঘাসের শ্যামলে, কোনো কোনো হৃদয়ের অন্দরমহলে। করিডোরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। ভোরবেলায় অপরূপ হাওয়া এসে গায়ে লাগে তার সমস্ত মাধুরী নিয়ে। স্নাত হয়ে যায় শরীরাত্মা। আর গভীর করে দেখি দু’একটি উড়ে আসা পাখি। আজ দেখছিলাম একটি শালিক পাখি- কালো বা খয়েরি রঙের মধ্যে যেন মোটা ব্রাশে টানে শাদা রেখা। কী যে অদ্ভুত সুন্দর! আজ যে জন্যে তোমাকে এই চিঠি লিখছি, তা নিষ্কারণে নয়। সেই প্রসঙ্গেই আসি সরাসরি।

ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই প্রকৃতপক্ষে আমাদের আধুনিকতার শুভ সূচনা। ইংরেজ মোটেই সদুদ্দেশে করেনি? তোমরা তো ইতিহাসের আমলের খোঁজ-খবর রাখো না। বাংলাদেশে আধুনিকতা ওরা এনেছে ঠিকই- কিন্তু সেটার মধ্যেকার অভিসন্ধিগুলোও ভুলে যেয়ো না। মাইকেল মধুসূদন দত্তের মতো কালোত্তর প্রতিভা খ্রিস্টধর্ম বরণ করেছিলেন। শেখ জমিরুদ্দীন হয়েছিলেন জন জমিরউদ্দীন- পরে আবার অবশ্য ইসলাম ধর্মে ফিরে এসেছিলেন ‘মুসলিম বাংলার রামমোহন’ (মুহম্মদ আবদুল হাইয়ের ভাষায়) মুন্সী মেহেরুল্লার সঙ্গে তর্কযুদ্ধে পরাজিত হয়ে। ডা: লুৎফর রহমান খ্রিস্টধর্ম গ্রহণের জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন, হননি শেষ পর্যন্ত। এই যে ক’টি উদাহরণ দিলাম, এর কারণ কি জানো? এক হচ্ছে এঁদের পথে সন্ধান। কিন্তু তার সঙ্গে যুক্ত করতেই হয়, খ্রিস্টীয় ধর্মযাজকদের সনাতন ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের বিরুদ্ধে ক্রমাগত রীতিমতো বই লেখা এবং অন্যবিধ সম্প্রচার।



তবে ভালো যেটুকু হয়েছিল, সেটুকু যেন ভুলে না যাই।

তার একটি নারীজাকৃতি।

তুমি নিশ্চয় জানো- রাজা রামমোহন রায় সতীদাহ প্রথা নিবারণ করেছিলেন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবাবিবাহ প্রবর্তন করেছিলেন এবং বহুবিবাহ রদ করেছিলেন। মুসলমান সমাজেও তখন বিধবা বিবাহ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মুন্সী মেহেরুল্লা আপ্রাণ খেটে মুসলমান সমাজে বিধবাবিবাহ চালু করেছিলেন ফের। আর স্ত্রী শিক্ষা শুরু হয়েছিল ক্রমশ। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের কবিতায় দেখবে এর বিরোধিতা। আসলে তো নারীশিক্ষা ব্যতিরেকে কোনো অগ্রগতি সম্ভব না। অনগ্রসর মুসলমান সমাজে ছিল অবরোধ প্রথা। এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে উচ্চকণ্ঠ ছিলেন বেগম রোকেয়া এবং সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী। মুসলমান সমাজে প্রথম গদ্যলেখিকা নবাব ফয়জুন্নেসা- বঙ্কিমচন্দ্রের সমসাময়িক। প্রথম কবি মীর আজিজুল রবীন্দ্রনাথের সমসাময়িক। বেগম রোকেয়ার ভূমিকা চিরস্মরণীয়। অবরোধ প্রথার বিরুদ্ধ কবিতায় এবং নারীশিক্ষার প্রবর্তনায়। ফলত ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সমাজের একটি বিরাট জাগরণ এবং পরিবর্তন ঘটেছিল। স্বাভাবিকভাবেই ছিল অনেক স্রোত-প্রতিস্রোত।

সৃজনশীল সাহিত্যে প্রথম নারীর ব্যক্তিত্বের প্রতিষ্ঠা করেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত। এই তথ্যটি মেঘনাদবধ কাব্য প্রকাশের দেড়শো বছর পরেও যেন আমরা জাগ্রত রাখি আমাদের মধ্যে। যেন না-ভুলি। বিশেষত সমাজে যাঁরা নারীর নাম প্রতিষ্ঠার জন্যে সংগ্রাম করে যাচ্ছি। নারীশিক্ষা আজকে ব্যাপক এবং সর্বস্তরে না হলেও তমসা কেটেছে। কিন্তু এখনো বিশাল সংখ্যক নারী অশিক্ষায় তমসাচ্ছন্ন। আর নারীনিগ্রহ?- এতো প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে বিরামহীন ঘটে চলেছে। খবরের কাগজে আর ক’টি সংবাদ প্রকাশিত হয়। টেলিভিশনে ক’টিই বা সম্প্রচারিত হয়। এই তো গতকালই তুমি তোমার জানা একটি পরিবারের যে ঘটনা বললে, সেটা মধ্যবিত্ত অনেক পরিবারেই নিরূপায় লোকচক্ষের অলক্ষ্যে ঘটে চলেছে তো চলেছেই। প্রতিকার ক’টি হচ্ছে? প্রতিবাদই বা কতখানি। আমরা টেলিভিশনে দেখছি, সংবাদপত্রে পড়ছি। সেটাতেই আমাদের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায়, বলো? তোমরা নতুন প্রজন্ম, তোমরা এর প্রতিকারের উপায় বের করো। এই আজো দাহ্যমান নারী সমাজকে তোমরা অগ্নি থেকে বাঁচাও। হ্যাঁ, যা বলছিলাম- মেঘনাদবধ কাব্য। এই ক্রান্তিকারী মহাকাব্যের প্রধান দু’টি নারীচরিত্রই অসাধারণ ব্যক্তিত্বময়ী- সীতা আর প্রমীলা। মাইকেল-চিত্রিত সীতা কোমল কিন্তু বিকিয়ে যাওয়া নয়- আত্মচারিত্রে অধিষ্ঠিত। আর প্রমীলা বাংলা সাহিত্যের প্রথম তেজস্বিনী নারী। (এখানেই তোমাকে বলি- নজরুল ইসলামের স্ত্রীর নাম তো জানোই; প্রমীলা। এটা কিন্তু তার সত্যিকার নাম নয়। তার সত্যিকার নাম আশালতা-আশালতা সেনগুপ্ত। নজরুলই তার নাম পালটে করেছিলেন প্রমীলা। নেপথ্যসূত্রটি এই যে, নজরুল যখন বাল্যে-কৈশোরে লেটোদলে ছিলেন তখন মেঘনাদবধ কাব্য-এর পালারূপ দিয়েছিলেন। তখন থেকে ঐ চরিত্রপাত্রের তেজস্বিতা ও ব্যক্তিতা তাকে মুগ্ধ-আচ্ছন্ন করেছিল। নজরুলের সমগ্র সাহিত্যে ক্রমাগত ধ্বনিত-রণিত হচ্ছে তেজস্বিতা। নজরুল তার পরিণীতার নাম প্রমীলা দেবেন না তো, দেবেঠ কে আর!)

তারপরও বলব নারীজাগৃতির ক্ষেত্রে একটি গ্রন্থই প্রথমতম নাম। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বীরাঙ্গনা কাব্য। এই বইয়ের কয়েকটি দীর্ঘকবিতা পত্রকাব্য- আমি যেমন তোমাকে লিখছি এই পত্র প্রবন্ধ। সাহিত্যিক পরিভাষায় একে বলে উৎধসধঃরপ গড়হড়ষড়মঁব বা মনোনাট্য। কবিতায় মনোনাট্য কিন্তু আজো লেখা হচ্ছে। কেবল এসব চিত্রায়নের কাজ এদেশে হয় না। মাইকেলের যা অভ্যেস- হিন্দু পুরাণের কয়েকটি নারী চরিত্রকে এক অসম্ভব দীপিতায় মাইকেল উজ্জ্বলিত করে তুলেছেন। ‘দশরতের প্রতি কেকয়ী’ বা ‘সোমের প্রতি তারা’- এসব প্রত্যেকটি কবিতা এখনও জ্বলজ্বলে করছে। এসব কবিতায় তোমরা সঞ্জীবিত সন্দীপিত হও না, এটিই আশ্চর্য লাগে। এসব কবিতার মৌতাতে মজো তোমরা, তবেই না সমাজ পরিবর্তনে এগোতে পারবে। কে বলে সাহিত্য হাতিয়ার নয়? মাইকেল-সাহিত্য, রবীন্দ্রসাহিত্য, নজরুল সাহিত্য সবই বাঙালির জাগরণের বাণী চিরদিনের জন্যে বহন করে চলেছে।

রবীন্দ্রনাথের মেজো বৌ গল্পের কেন্দ্র চরিত্রটিকে ভুলে যাবে? আর তার গল্প-উপন্যাসের অনেক চরিত্র। নারী জাগৃতির ক্ষেত্রে বলব বীরাঙ্গনা কাব্য-এর পরবর্তী সোপান চিত্রাঙ্গদা। চিত্রাঙ্গদাও পৌরাণিক চরিত্র। শরৎচন্দ্রের উপন্যাসের কত যে নারীচরিত্র আপন ব্যক্তিত্বে মহীয়ান তা তোমার ভালো করেই জানা আছে। বেগম রোকেয়ার পদ্মরাগ উপন্যাসটি পড়ো একবার। দেখবে, রোকেয়া শুধু নারীজাগৃতির প্রবন্ধ-নিবন্ধই রচনা করেননি- উপন্যাস রচনায়, ব্যক্তিত্বময়ী নারীচরিত্র সৃষ্টিতেই তার অসামান্য কুশলতা। আমার দুঃখ হয়, বেগম রোকেয়ার এই অসাধারণ উপন্যাসটির দিকে কোনোদিন কারো নজর পড়ল না।

নারীজাগৃতির এরকম দ্রুত আলেখ্যরেখা অঙ্কনের পর এবার সরাসরি নজরুল ইসলামের কথায় চলে আসি। নারীর প্রতি মর্যাদা প্রদর্শনে নজরুলের ভূমিকা তার বিবাহের ঘটনাতেই প্রকাশিত। আমি যতদূর জানি- প্রমীলাকে নজরুল তার স্বধর্মে অধিষ্ঠিতা রেখেই বিয়ে করেছিলেন। নজরুল লিখেছিলেন, ‘আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।’ কতকাল আগে কবি বলেছিলেন, কিন্তু আজো আমরা ক’জন বুকে হাত দিয়ে একথা বলতে পারি। আজো অন্তত আমাদের সমাজ পুরুষশাসিত।

নজরুলের কুহেলিকা উপন্যাসের কেন্দ্র নারী চরিত্রটির কথা মনে পড়ছে। মনে পড়ছে অনেক কবিতা-গানের কথা। ‘নারী তুমি ফেরদৌসের ফুল’ নামে কবিতা। জয়ন্তী- আবদুল কাদির সম্পাদিত পত্রিকাটির নাম কে রেখেছিল? নজরুলই তো। প্রথম সংখ্যাটিতেই প্রকাশিত হয়েছিল কবির সেই বিখ্যাত গানটি- ‘জাগো নারী, জাগো বহ্নিশিখা।’ কিন্তু আমি যে একটিমাত্র কবিতার কথা বলতে বসেছি আজ, সেটিই বলি একটু ছড়িয়ে। নজরুলের সাম্যবাদী কবিতাগ্রন্থের (১৯২৫) ‘নারী’ কবিতাটি।

ও, তার আগে একটি বিশিষ্ট ধারার কথা না বললে অন্যায় হবে। নজরুল ইসলামের সঙ্গীত-পরিকরদের মধ্যে দেখবে যত পুরুষ ততজনই নারী। একসঙ্গে এত মহিলা-সঙ্গীতশিল্পী কি বাঙালির সঙ্গীত ইতিহাসে এসেছে কখনো? বিষয়টি একটু থির হয়ে বিবেচনা কোরো।

আরো একটি কথা।

বেগম রোকেয়া (যিনি লিখতেন মিসেস আর,এস হোসেন নামে), প্রকৃতার্থে তিনি অগ্নিকন্যা, বহুদিন খুঁজে নজরুলের একটি চিঠিতে একবার তার সমুজ্জ¦ল উল্লেখ পেয়েছি। পরে তো রীতিমতো আশ্চার্যভাবে হাতে পেয়ে গেলাম বেগম রোকেয়াকে নজরুলের নিজের হাতে লেখা উপহার প্রদত্ত ছায়ানট বইটি। সেখানে কবি তাকে সম্বোধন করেছেন ‘নানীআম্মা’ বলে। আমি তো মনে করি আমাদের চিরকালের মাতামহী বেগম রোকেয়া। এখানে উল্লেখ করতেই হবে, বেগম রোকেয়ার অন্তরঙ্গ দুই শিষ্যা- মিসেস এম, রহমান এবং শামসুন নাহার মাহমুদ-এর সঙ্গে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা ছিল। ‘মিসেস এম,রহমানকে নজরুল ‘মা’ বলতেন, তাকে গ্রন্থও উৎসর্গ করেন। বেগম রোকেয়া ও মিসেস এম,রহমান দু’জনই নজরুলের ধূমকেতু পত্রিকায় লিখেছেন। শামসুন নাহার মাহমুদ ছিলেন নজরুলের স্নেহধন্যা, চট্টগ্রামে ওঁদের বাড়িতে থেকেছেন, বাহার (হবীবুল্লাহ বাহার) নাহার (শামসুন নাহার মাহমুদ)-কে নজরুল গ্রন্থও উৎসর্গ করেছেন। বিশেষ করে বলব, বেগম রোকেয়া ও মিসেস এম, রহমানের মতো তীব্র তীক্ষè লেখকের রচনার অনুরাগী ছিলেন নজরুল।

মূল প্রসঙ্গে আসি এবার-

‘নারী’ কবিতাটি কতবারই তুমি লাইনকে লাইন মুখস্থ বলে গেছ তুমি। তুমি অসামান্য শ্রুতিধর। কিন্তু লক্ষ্য করেছ কি, এই কবিতার মধ্যেই আছে পরমাশ্চর্য স্মরণীয়তা-গুণ। জীবনানন্দ-দাশ উদ্ধৃত অংশে কথিত 'গবসড়ৎধনষব ংঢ়ববপয ’ প্রায় সব পঙক্তি-যুগ্মক। কবিতাটি শুধু তোমারই প্রিয় নয়- স্বয়ং নজরুলেরও প্রিয়। ‘নারী’ কবিতাটি নজরুল অনেক সভা-সমিতিতে আবৃত্তি করেছেন, এমনকি কবিকণ্ঠে এই কবিতাটি রেকর্ডকৃত হয়ে আছে। মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে এই কবিতাটির গীতিরূপও চমৎকার লাগে আমার। পুরো কবিতাটিই উদ্ধৃতিযোগ্য, কয়েকটি মাত্র যুগ্মক পঙক্তি উৎকলন করবঃ

১. সাম্যের গান গাই-

আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই।

২. বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি, চির কল্যাণকর,

অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।

৩. তাজমহলের পাথর দেখেছ, দেখিয়াছ তার প্রাণ?

অন্তরে তার মোমতাজ নারী, বাহিরেতে শাজাহান।

৪. পুরুষ হৃদয়হীন,

মানুষ করিতে নারী দিল তাহে আধেক হৃদয় ঋণ।

৫. সেদিন সুদূর নয়-

যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়।

একথা কি জানো- নজরুল ইসলাম একটি রাজনৈতিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন?- ‘লেবার স্বরাজ পার্টি’। একা নন- হেমন্তকুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহম্মদ, নজরুল ইসলাম প্রমুখ। এই পার্টিরই মুখপত্র ছিল লাঙল (১৯২৫)-নজরুলের লাঙল। এই লাঙল এর প্রারম্ভিকায় যদিও থাকত চন্ডিদাসের প্রভাস্বর বাণী- ‘শুনহ মানুষ ভাই/সবার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই।’ লাঙল-এর প্রথম সংখ্যাতেই (১লা পৌষ ১৩৩২) ঐ সংখ্যার ‘সর্বপ্রধান সম্পদ’ সাম্যবাদী’র ১১টি কবিতা। সেকালে তো ছিল লেটার প্রেস- আমার অধিকাংশ বইও ঐ লেটার প্রেস থেকেই বেরিয়েছে। সার কথা এইঃ লাঙল-এর ঐ সংখ্যা থেকেই প্রেস-ম্যাটার নিয়ে গ্রন্থাকারে (পেপারব্যাকে) বেরিয়েছিল সাম্যবাদী বইটি। ‘বেঙ্গল পাবলিশিং হোম’ থেকে প্রকাশিত হয়েছিল, প্রকাশক শামসুদ্দীন হুসেন- লাঙল-এর ‘কর্মাধ্যক্ষ’।

মধ্যযুগের চন্ডিদাস (আমার অতিপ্রিয়-অতিপ্রিয়। তোরা একটু পড়। তুই এত সুগভীর কাব্যবোদ্ধা, তুই কেন চন্ডিদাস পড়িস না?) নজরুলকেও কিভাবে সাম্যবাদীর কবিতার পর কবিতায় উদ্বোধিত করেছেন, দ্যাখো চন্ডিদাসের উপরে উদ্ধৃত কবিতার সঙ্গে- ‘গাহি সাম্যের গান-/যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান।’ (সাম্যবাদী), ‘গাহি সাম্যের গান-/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ (মানুষ), ‘সাম্যের গান গাই!-/যত পাপী তাপী সব মোর বোন, সব হয় মোর ভাই।’ (পাপ), ‘সাম্যের গান গাই-/আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী, কোনো ভেদাভেদ নাই।’ (নারী), ‘সাম্যের গান গাই/যেখানে আসিয়া সম-বেদনায় সকলে হয়েছে ভাই।’ (রাজা-প্রজা), ‘গাহি সাম্যের গান-বুকে বুকে হেথা তাজা সুখ ফোটে, মুখে মুখে তাজা প্রাণ!’ (সাম্য)

‘নারী’ কবিতার অনেক পঙক্তির মধ্যেই এত গভীর সত্য খচিত আছে, এত গহন কবিত্ব খুঁড়ে এনেছি যে পঙক্তির পর পঙক্তি তোমাকে শোনানোর লোভ সামলানো কঠিন। দু’একটি শোনোঃ ‘পুরুষ এনেছে দিবসের জ্বালা তপ্ত রৌদ্রদাহ,/কামিনী এনেছে যামিনী-শান্তি, সমীরণ, বাহিকহ।’ অথবা ‘স্বর্ণ-রৌপ্যভার/নারীর অঙ্গ-পরশ্য লভিয়া হয়েছে অলংকার। আমার তো মনে হয়, এসব দুয়েকশো বছর পরে প্রবাদ-প্রবচনে পরিণত হবে- যেমন ভারতচন্দ্রের অনেক উক্তি হয়েছে, লোকে জানেও না কার রচনা। সাম্যবাদীর তথা নজরুলের আরো অনেক কবিতা-গানের মতো পৌরাণিক উল্লেখ ধষষঁংরড়হ আছে ‘নারী’ কবিতায়ও। নজরুলের স্বভাবশোভন নতুন অর্থে অন্তরাখ্যানে পরিপূর্ণ। তোমরা একটু নিজেরা পড়ে ভাষ্য রচনা করো।

মাইকেলের বীরাঙ্গনা, রবীন্দ্রনাথের চিত্রাঙ্গদা নাট্যরসে নিষিক্ত, শেষ বিচারে কিন্তু কবিতা হিসেবে এই দুটির উত্তরাধিকারী নজরুলের ‘নারী’ কবিতাটি। বাংলার নবজাগরণের একটি চরিত্রলক্ষণ নারীর অধিকার রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন শিরাজী এবং আরো অনেকের ইতিহাস চেতনা বহন করে আরো এগিয়ে গিয়েছিলেন নজরুল। আরো কেলাসিত। যেন শুধু তার বক্তব্যের সারাৎসার একটি অভঙ্গুর শিশিতে ভরে বাঙালি পাঠককে উপহার দিলেন তিনি।

তোমার মতো দীপ্তিমতী মেয়ে- নজরুলের ভাষায় ‘বহ্নিশিখা’- ছাড়া এই চিঠির প্রাপিকা কে হবে আর! -তোমার শিল্পী।

৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪১৭, সকাল


সূত্র: ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী ২১.০৫.২০১০

No comments:

Post a Comment