Friday, May 21, 2010

নিম্নবর্গ মানুষের সাধক নজরুল - পাবলো শাহি

কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় কোল-মুণ্ডা দেবী চণ্ডী বা চামুণ্ডা শব্দের ব্যবহার এবং এর ব্যুৎপত্তিগত তথ্য ও তাৎপর্য খোঁজা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। বাঙালির রক্তের আলোড়নে প্রথম আদিগান হয়ে উঠেছিল যে 'নিষাদ' জাতি, তা বোধ করি নেগ্রিটো রক্তের সঙ্গে কোল-মুণ্ডা-ভীল-সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আত্মস্বর। নজরুল সেই বাঙালি জাতিসত্তার আদিম এষণার হাত ধরে 'চামুণ্ডা' শব্দের ফাঁদে সাকার ও আকার দিয়ে আমাদের হাজার বছরের ভেসে যাওয়া নাভিচিহ্নকে ধরে দিতে চেয়েছেন। তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণের চৈতন্যে ও ভাব-বস্তুবিশ্বে চণ্ডী, শিব, কালিয়া, কালী এক অভেদাত্দা, যেন তা রুদ্ররূপে চামুণ্ডা শিবের প্রলয়-ঘূর্ণিনাচে আমাদের অন্তর আত্মায় ভস্মীভূত।

শিব এক জটাধারী, গাছের পাতা পরে সাপ মাথায় নিয়ে ধ্যান-সাধনার অগি্নবাণ লাভ করা এক পূত-পবিত্রহীন সাধুসন্ত। আর চামুণ্ডা তো নিষাদ জাতির অনবচ্ছিন্ন হিংস্রতার বহুল বিস্তার। তাকে ভালোবেসে নয়, ভয়ে সবাই হয় হস্তগত; করতলগত হয় পুরুষশিবের রুদ্র। আদিমতম ইতিহাস থেকে মহাভারত পর্যন্ত জানা যায়, এই 'চামুণ্ডা' ছিল মাতৃরূপী, শাসকরূপী প্রজাহৈতষীরূপী এক অনন্ত নারীর মূর্তি। সে সন্তান রক্ষায় নিপুণ, শাসক হিসেবে সুশাসক আর প্রজাহিতৈষী হিসেবে তিমিরে যাওয়া মানুষের অনল উদ্ধারকারী। 'চামুণ্ডা' তাই আভরণমাত্র নয়, তার নিজের হাতে নিজের অভিষেক, নিজেরই স্বয়ম্ভু আত্দোন্মোচন। প্রতিটি জাতিসত্তা কোটি কোটি মায়াপ্রপঞ্চ-উৎসার থেকে যে ছায়াময় বিশ্বকে খাড়া করে, বাঙালির জাতিসত্তায় তার একটি নিশ্চয় একুশের 'শহীদ মিনার'। সেইখানে 'চামুণ্ডা' আছে, তার দুই পাশে সঙ্গী তার পুত্র আর কন্যা। মাতৃতান্ত্রিকতাকে যেন শিল্পের হাতে নিংড়ে তৈরি করা হয়েছে।

এই বাঙালির অস্ট্রিক-দ্রাবিড় জনগোষ্ঠী আর কোল-মুণ্ডা-ভীল-সাঁওতাল 'নিষাদ' প্লাবিত জনগোষ্ঠী মিলে এখানকার নারীকে ফুটিয়েছে রাতের তিমিরে। তাই বাঙালি নারী ডালিয়া, টাইম ফুলের মতো রঙিন নয়; বকুল, বেলি, রজনীগন্ধা কামিনীর মতো সাদা বর্ণহীন। কিন্তু তার বক্ষে আছে আকুতি ও সংক্রামক-আলোড়িত করা ঘ্রাণ, যা কাগুজে রঙিন নারীর বাহুলতাতে নেই। এই যে সাধনাকে নিংড়ে তোলা, সর্বাংশে বলয়িত রুদ্রে যার প্রকাশ, তাই তো 'চামুণ্ডা' রূপ ধরে বাঙালির যাপিত জীবনের আভাসে ফুটে আছে। সংগত তাৎপর্যে 'চামুণ্ডা' শব্দের অর্থপতি (সিগনিফায়ার) নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'তে কিভাবে উন্মাদ স্বরের উৎসার হয়ে উঠেছে, তা থেকে আমরা এই কথায় আত্দসমর্থনের চূড়ান্ত উপায় বা প্রস্তাব ভাবি। ভাষাবিদ্যার এই বক্তব্য অনুসারে নজরুলের 'বিদ্রোহী' কবিতার 'চণ্ডী' শব্দের অভীপ্সায় গভীরতর 'অর্থ' গড়েপিটে নেওয়া যায় এইরূপে :

আমি রুষে উঠে যবে ছুটি মহাকাশ ছাপিয়া,
ভয়ে সপ্তনরক হাবিয়া দোজখ নিভে নিভে যায় কাঁপিয়া!
আমি বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া।
আমি শ্রাবণ-প্লাবন-বন্যা,
কভু ধরণীরে করি বরণীয়া, কভু বিপুল ধ্বংস-ধন্যা
আমি ছিনিয়া আনিব বিষ্ণু-বক্ষ হইতে যুগল কন্যা!
আমি অন্যায়, আমি উল্কা, আমি শনি,
আমি ধূমকেতু-জ্বালা, বিষধর কাল-ফণি!
আমি ছিন্নমস্তা চণ্ডী, আমি রণদা সর্বনাশী
আমি জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি!

নজরুলের কাব্য অর্থবিদ্যার এই 'ছিন্নমস্তা চণ্ডী' ভীষণতার আকার-সাকার প্রতিরূপ। এই সংক্রামক কাব্যবাক্যক্ষণে নজরুল 'রুষে উঠেন মহাকাশ ছাপিয়া'; 'সপ্তনরক হাবিয়া দোজখ কাঁপিয়া', 'বিদ্রোহ-বাহী নিখিল অখিল ব্যাপিয়া', 'বিপুল ধ্বংস-ধন্যা', 'অন্যায়, উল্কা, শনি হইয়া', 'বিষধর কাল-ফণি' হইয়া 'ছিন্নমস্তা চণ্ডী' রূপ ধরে 'জাহান্নামের আগুনে বসিয়া পুষ্পের হাসি' হেসে অর্থময় ছায়াবিশ্বকে খাড়া করে তুলেছে। চণ্ডীর জন্য এই উপলব্ধির আয়োজন নজরুলের কাব্যে ছড়িয়ে পড়েছে বিচিত্র রূপপ্রপঞ্চে, তা যেমন নিষ্ঠুর, তেমনি সর্বাংশে রুদ্র অভিমুখী। সেই রুদ্রস্বরের টানে আমাদের বোধিদ্রুমের সংবিৎ বারবার তাই আলোড়িত, আভাসে চঞ্চল হয়ে ওঠে। তাই চিরপ্রণম্য এই রুদ্রশক্তি কবির যন্ত্রণা প্রকাশকে অভিষিত করল নমস্যে-'শুম্ভ-নিশুম্ভ-বিমর্দিনী চণ্ডী/নমো নমঃ দশপ্রহরণধারিণী', 'মর্দিনী' চণ্ডীকে কবি 'বিশেষ করে মর্দিনী' করে তুলেছেন। এই নমঃ, নমস্য বিশেষ শক্তির জয়কে গভীর অর্থময় বা প্রণামে প্রণামে নমস্যেই স্বরিত হলো বারবার। দুর্গাদেবীর এই চণ্ডরূপ, কোপনস্বভাবা নারীর প্রতিমূর্তি যেন রুদ্রের ঘূর্ণিতে মূর্তিমতী হয়ে ওঠে সে যেন 'ঝড়-কপোতী বৈশাখ সখী'।

আর দুর্গার 'চামুণ্ডা' রূপ তো 'চণ্ড' ও 'মুণ্ড' নামক অসুরদ্বয়ের হন্তারক হিসেবে। ভাষাবিদ্যার বক্তব্য অনুসারে এইখানে দুর্গার উগ্রস্বভাবা তাৎক্ষণিক ও চিরকালীন রুদ্র মর্মার্থ প্রকাশিত। যেন ধ্বনি উচ্চারণে এক গভীর অলৌকিক শক্তিতে জ্বলতে থাকে চারিপার্শ্ব; অর্থের ও ধ্বনির বিপুল বিস্তার অনুষঙ্গের বোঝাটি এইভাবে নজরুল আমাদের মনের কন্দরে প্রকাশ করেছেন। নজরুলীয় ভাষাবিদ্যার শর্ত অনুসারে চণ্ডী তাই হয়ে উঠেছেন কোল-মুণ্ডা-ভীল-সাঁওতাল জনগোষ্ঠীর টোটেম-ট্যাবুতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠা 'খোয়াব' বা 'ধারণা'র প্রতিনিধি। ঊহ্যত, জনগোষ্ঠীর প্রবাদ-প্রবচন-বাগ্ধারায় ফোটে যে বিশ্বাসের বীজ, তা-ই এককালে ধর্ম ও সংস্কার এবং সংস্কৃতির ভিতর-পিঠ হয়ে ওঠে। আমি বলতে চাই যে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জাতীয় জীবনের মূল সত্তাকে অর্থাৎ জাতিসত্তার সেই গূঢ়তম বীজ উপ্ত করেছেন ভাষার প্রতীকতম 'চামুণ্ডা' শব্দের মধ্যে। তাই তিনি (নজরুল) পত্র রচনাতেও 'চামুণ্ডা' প্রসঙ্গ এনেছেন একাধিকবার।

এক পত্রে তিনি সহধর্মিণীকে 'চণ্ডী'রূপে দেখেছেন 'তুই শুনে ভয়ানক আশ্চর্য হবি যে, তোর কোঁদলে, চামুণ্ডা, রণ-রঙ্গিনী ভাবীসাহেবা অত্রস্থানে সশরীরে বর্তমান থাকা সত্ত্বেও...' অন্য এক পত্রে কনিষ্ঠ পুত্র কাজী অনিরুদ্ধকে তিনি লিখেছেন_'তোমরা বীর ছেলে হয়ে উঠবে, দুষ্টুমি করো না, কেঁদো না, জল ঘেঁটো না। আমি রোজ তোমাদের দেখে আসি, চুমু খাই, তোমরা যখন ঘুমোও। চণ্ডীর সঙ্গে খেলা করবে। ঘুমোলে আমায় দেখতে পাবে। তখন আমি কোলে নেব। আরো ফুল পাঠিয়ো...' বাবা নিনামণি কাজী অনিরুদ্ধকে তিনি চণ্ডীর সঙ্গে খেলাতে চেয়েছেন। এই অভীপ্সা তিনি লাভ করাতে চেয়েছিলেন যেমনি বাল্মীকি কিংবা কালিদাসের জড়বুদ্ধি ঘুচে গিয়েছিল, নজরুল যেন সেই পরস্পরবিরোধী আবেগের যুগপৎ সমারোহে আর বিবিধ আততি মিলিয়ে বিবিক্ত 'চামুণ্ডা' শক্তিকে ধারণ করেছিলেন। ছেলেকে দুষ্টুমি না করতে বলা ও চণ্ডীর সঙ্গে খেলতে বলা সেই শব্দতাৎপর্য প্রকাশ করে। নজরুল তাঁর জন্মদিনের কথা বলতে গিয়ে উল্লেখ করেছেন, 'আমি যেদিন জন্মেছিলাম, সেদিন নাকি ভীষণ ঝড়ে আমাদের ঘরের চাল উড়ে গিয়েছিল। সেদিন থেকেই আমি শক্তির উপাসক।' এই শক্তির উপাসনা চলে তাঁর কালী, চণ্ডী, চামুণ্ডা, শিবের ভজনায়। অন্তজীবনের এই রুদ্র সাধনাই নজরুলের চালিকাশক্তি। তাই তিনি অর্থের স্থাবর চূড়াগুলোকে এইভাবে শব্দবজ্রবাণে কালী, চামুণ্ডা ভজনাগীতে তর্কাতীতভাবে আলাদা করে তুলেছেন :

ভবানী শিবানী কালী করালী মুণ্ডামালী
অম্বিকে তম্বিকে আদ্যাশক্তি তারা শ্যামা,
ত্রিভুবন ঈশ্বরী গো দনুজদলনী বামা;
প্রসীদ বরদা মাগো চরণে আহুতি ঢালি
অষ্টম খণ্ড/পৃষ্ঠা-৮৩-৮৪

ভবানী শিবানী দশপ্রহরণধারিণী
দুখ-পাপ-তাপ-হারিণী ভবানী
কলুষ-রিপু-দানব-জয়ী
জগৎ-মাতা করুণাময়ী
জয় পরমাশক্তি মাতা
ত্রিলোকধারিণী
ঐ/পৃষ্ঠা-২০৯

ফণির ফণায় জ্বলে মণি
কে নিবি তাহারে আয়
মণি নিতে ডরে না কে
ফণির বিষজ্বালায়
করেছে মেঘ উজালা
বজ্র মণি মালা,
সে-মালা নেবে কি কালা,
মরিয়া অশনি যায়
ঐ/পৃষ্ঠা-২৯০

রক্ষা-কালীর রক্ষা-কবচ আছে আমায় ঘিরে।
মায়ের পায়ের ফুল কুড়িয়ে বেঁধেছি মোর শিরে
সপ্তম খণ্ড/পৃষ্ঠা-২৩৮

আমি রচনার শুরুতেই লিখেছি, 'চামুণ্ডা' শব্দের অর্থপতিই এই রচনার মূল বিষয় হিসেবে প্রতিপাদ্য। নজরুল তাই 'চামুণ্ডা' ভাষাশব্দ নির্মাণ দ্বারা দুই প্রস্থ অর্থমূল্য এঁকেছেন আমাদের মনে। (এক.) মাতৃতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা, যা বাংলার প্রাচীন মানসলোকে প্রতিষ্ঠিত ছিল (দুই.) তার প্রভাব ভাষার গূঢ়তম প্রদোষে আজও ধাবমান। অর্থাৎ অর্থের প্রসার হয়, ভাষার মেটাফর ঘটে যায়, তবু তা শব্দের অর্থ ঠেলে পুরনো ট্যাবুর মূল প্রস্তাবকে পাল্টাতে পেরে ওঠে না। সে কারণে বাংলা ও বাঙালির মিলনের এই দরকারি উপাদান তাই 'চামুণ্ডা'। আমার ছোট্ট এই লেখায় সময়ের অগি্নজলের পরীক্ষা উত্তরণের মোক্ষম উপায় হিসেবে আমি এ 'চামুণ্ডা'কে উদাহরণ হিসেবে জোগাড় করে অনিধিগম্য বিচ্ছেদলোক থেকে নিজেদের, বাঙালিকে সরানোর বা আত্দরক্ষার নজরুলের এই 'বর্ম' দ্বারা ঘিরতে চাই। নজরুলের যে দাহিকাশক্তি 'শাক্ত' সম্প্রদায়ের সাঁওতাল দেবী 'কালী' আর কোল-মুণ্ডা দেবী 'চামুণ্ডা'; তারাই যেন নৈঃশব্দ্যের ভেতর জীবনব্যঞ্জনা তোলা বাঙালির বুনোব্যাপিতা। আর তাঁর রচিত শব্দমালার মধ্যে নজরুল তাই শিবের গাজনের মতো নির্বাণ লাভ করে এই নিম্নবর্গের মানুষের কল্পদেবী 'চামুণ্ডা', 'চণ্ডী', 'কালী'র শক্তিরূপ ধরে হয়ে উঠেছেন প্রাচ্যের তথা বাঙালি নামক জাতিসত্তার ওঙ্কার, কলিজা ছেঁড়া ধ্বনির চিৎকার।



সূত্র: কালের কন্ঠ: শিলালিপি: ২১.০৫.২০১০

No comments:

Post a Comment