Thursday, May 27, 2010

কবি ও দার্শনিক - আ. ফ. ম উবায়দুর রহমান

কবির কাজ আবেগ-অনুভূতি নিয়ে আর দার্শনিকের কাজ চিন্তা ও যুক্তি নিয়ে। উভয়েই কিন্তু তাদের স্বস্ব কাজের জন্য বেছে নেন একটি সাধারণ মাধ্যম যা হচ্ছে ভাষা। এই ভাষা ব্যবহার করেন বলেই যিনি কবিতার চর্চা করেন তিনি শিল্পী হয়েও কবি, চিত্রকর নন এবং যিনি দর্শন চর্চা করেন তিনি দার্শনিক, স্থপতি নন। স্থপতি তাঁর কর্মের মাঝে তাঁর দর্শনকে লুকিয়ে রাখেন।, কিন্তুু দার্শনিক তা প্রচার করেন লিখে বা বক্তৃতার মাধ্যমে। কিন্তুু ভাষাটা শুধুই একটি মাধ্যম, কবিতা বা দর্শনের উপকরণ নয়। চিত্রকর বা স্থপতির মত কবি এবং দার্শনিকেরাও বিচিত্র সব উপকরণ নিয়ে কাজ করতে পারেন এবং করেন। সাধারণত: মানুষের আবেগ অনুভূতিকে সবচেয়ে বেশী নাড়া দেয় যে জিনিষটা তা হচ্ছে প্রেম, আর তাই এটিকেই বেশীর ভাগ কবি তাঁদের কবিতার উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করেন। একই ভাবে জীবন ও জগতের মৌল চরিত্র।

মানুষের চিন্তাকে বেশী উদ্দীপ্ত করে বলে মেটাফিজিক্স বা অধিবিদ্যাই দর্শনের মুখ্য আলোচ্যবিষয় বলে বিবেচিত হয়। কিন্তু কবি বা দার্শনিক কেউ তাদের কাজের পরিধি এ দুটো বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখেননি বা রাখতে পারেননি। কবিতা বা দর্শনের উপজীব্য হিসাবে তাই বিচিত্র সব জিনিষের সমাহার দেখা যায়।অবস্থাটা এখন এমনি যে দার্শনিক এবং কবি উভয়ই তাদের দর্শন এবং কবিতার মাধ্যম যে ভাষা তাকেও তাদের স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের কর্মের উপজীব্য হিসাবে নিয়েছেন। আজকাল যাকে আমরা বিশ্লেষনী দর্শন বলি তা মূলত: ভাষা বিষয়ক দর্শন। ভাষার প্রশস্তিতে, বিশেষ করে আমাদের বাংলা ভাষার প্রশস্তিতে লেখা কবিতার সংখ্যা ও নেহায়েত কম নয়।



বিষয় নির্বাচনে দার্শনিক ও কবির এই ব্যাপক স্বাধীনতা সত্ত্বেও গোড়াতেই তাদের মধ্যেকার যে পার্থক্যের কথা বলেছি তা কিন্তুু মুছে যায় না। যে কোন অবস্থায়ই একজন কবি, কবিই এবং দার্শনিক, দার্শনিকই। প্রশ্ন উঠতে পারে, তবে যে কবি-দার্শনিক এবং দার্শনিক কবির ধারনা রয়েছে তা কি অলীক?

সত্যের খাতিরে বলতে হবে আসলে ব্যাপারটা তাই; তবে একটি বিশেষ অর্থে এই ধরনের অভিধা অর্থপূর্ণ আর তা হচ্ছে একজন কবি যখন দার্শনিকের মূল বিষয়ে অর্থাৎ জগত ও জীবনের মূল প্রশ্ন সম্পর্কে কবিতায় তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন আমরা তখন তাকে দার্শনিক কবি বলি, আর একজন দার্শনিক যখন কবির মূল বিষয়ে, যেমন প্রেমের ব্যাপারে কিছু বলেন তখন তাকে আমরা কবি দার্শনিক বলতে পারি। এই সীমিত অর্থেই জগতের বড় বড় কবিরা দার্শনিক কবি বলে পরিচিতি পেয়েছেন। এই অর্থেই আমাদের জাতীয় কবি নজরুল ইসলামকেও একজন দার্শনিক কবি বলতে পারি, অবশ্য যদি দার্শনিক কোন বিষয় তিনি তাঁর কবিতায় অবতারনা করে থাকেন। এই রচনাটি উক্ত বিষয়ে আলোকপাত করারই একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস। প্রয়াসটি ক্ষুদ্র একারনে যে এখানে নজরুলের মাত্র একটি কবিতাতেই আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখব। কবিতার নাম ‘বিদ্রোহী।’

২.

‘বিদ্রোহী নিয়ে নজরুল নিজেই ছিলেন উচ্চকণ্ঠ। শোনা যায় প্রকাশের পর পর তিনি রবীন্দ্রনাথকে এটি দেখাতে নিয়ে যান এবং সেখানে এক আবেগাত্মক ও নাটকীয় দৃশ্যের সৃষ্টি করেন। আপন সৃষ্টি সম্পর্কে কতটুকু আস্থা থাকলে এটা সম্ভব তা সহজেই অনুমান করা যায়। কবির এ আস্থার মূলে ছিল তার এমন একটি আবিস্কার যা এ যাবতকাল ছিল বাংলা সাহিত্যে অশ্রুতপূর্ব। তিনি তার কাব্যে এমন একটি দর্শনের অবতারণা করেছিলেন যার বিষয়ে তাঁর আগে অন্য কোন কবি সচেতনতা প্রকাশ করেছেন বলে আমার জানা নেই।

এখানে প্রথমেই বিদ্রোহী কবিতাটির আঙ্গিক নিয়ে কিছুটা আলোচনা করা যেতে পারে। কবিতাটি শুরু হয়েছে অত্যন্ত নাটকীয়ভাবে ‘বলবীর’ কথাটি দিয়ে। এই ধরণের আদেশ বাচক উক্তি দিয়ে বক্তব্য প্রকাশের ঘটনাটিকে আমরা কিভাবে ব্যাখ্যা করব? এটি কি তার নিজস্ব উদ্ভাবন? না, অন্য কোন সূত্র থেকে তিনি তা গ্রহণ করেছেন? তিনি একজন সৈনিক ছিলেন, অতএব এই ষ্টাইলে কবিতায় কথা বলাটা তার পক্ষে সম্ভব বলা যায়, কিন্তু তাহলেতো নজরুল কাব্যে প্রায়শই এর সাক্ষাৎ মিলতো, যা সত্য নয় বলেই আমার বিশ্বাস। সমগ্র বাংলা সাহিত্যে এই ষ্টাইলটি খুব প্রচলিত সেটাও আমার মনে হয় না। তবে অশৈশব কবির পরিচিত একটি গ্রন্থে এই প্রকাশ ভঙ্গির ব্যবহার খুবই চোখে পড়ার মত। এ গ্রন্থটি হচ্ছে মুসলমানদের পবিত্র ধর্ম গ্রন্থ কুরআন।

যদি বিষয়টিকে একটি ক্লু হিসাবে গ্রহন করি তাহলে বিদ্রোহী কাব্যটির উৎস এবং দর্শন নিয়ে খুব সহজেই একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব। তবে এ ব্যাপারে আলোচনার আগে কবি বীরকে দিয়ে কি বলাতে চান সেটা বিবেচনা করা যাক। বলা যায় কবিতাটির প্রথম বারটি ছত্রেই তিনি তা বলে দিয়েছেন। আমি এখানে তা তুলে ধরছি।

বল বীর

বল উন্নত মম শির।

শির নেহারী আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রির

বল বীর বল মহাবিশ্বের মহাকাশ ফাড়ি

চন্দ্র সূর্য গ্রহতারা ছাড়ি

ভূলোক দ্যুলোক গোলক ভেদিয়া

খোদার আসন আরশ ছেদিয়া

উঠিযাছি চির-বিস্ময় আমি বিশ্ব-বিধাত্রীর।

মমললাটে রুদ্রভগবান জ্বলে রাজ-রাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর

বল বীর

আমি চির উন্নত শির।৪

ছত্র কটির যা মর্মার্থ তা হচ্ছেঃ বীরের মর্যাদা পর্বতের মর্যাদার চেয়ে বেশী। সে আকাশ এবং পৃথিবীকেও এ ব্যাপারে ছাড়িয়ে গেছে এবং এমন কি খোদার আসন (আরশ) তথা ক্ষমতাকেও সে অগ্রাহ্য করেছে আর এ কারণে খোদার (ভগবানের) রোষানল রাজটীকার মতই তার কপালে জ্বলে।

এ বক্তব্যের সূত্র খুঁজতে গিয়ে পূর্বোক্ত ক্লুটিকে যদি আমরা কাজে লাগাই তাহলে নিম্নোক্ত বক্তব্যটির প্রতি আমি অনুসন্ধিৎসু প্রত্যেককেই দৃষ্টি দিতে বলবঃ

নিশ্চয় আমরা আকাশ মন্ডল ও পৃথিবীকে এবং পর্বত মালাকে এই আমানত গ্রহণ করার প্রস্তাব দিয়েছিলাম, কিন্তু তারা এই ভার বহনে অস্বীকৃতি জানিয়ে ছিল। মানুষ সে ভার গ্রহণ করলো, কিন্তু সে হয়ে গেল অন্যায়কারী ও কান্ডজ্ঞানহীন মূর্খ উম্মাদ? (৩৩-৭২, আল কুরআন)

এটা কি স্পষ্ট নয় যে নজরুল যেকটি বিষয়ের কথা তার কাব্যে উল্লেখ করেছেন, এদের একেবারে সব কটিই (পর্বত, পৃথিবী এবং আকাশ মন্ডল, খোদার আরশ তথা কতৃত্ব এবং তার অসন্তুষ্টি) এখানে উপস্থিত? এটা কি কাকতালীয় হতে পারে? খোলা মন নিয়ে দেখলে যে কেউ স্বীকার করতে বাধ্য যে নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার সূত্র কুরআনের এই আয়াতটিই।

আয়াতে উল্লেখিত আমানতের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইকবাল একে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা বলেছেন যা আদিতে ছিল আল্লাহর একচ্ছত্র গুণ এবং যা তিনি কিছু পরিমানে মানুষকে দিয়ে তার যথার্থ প্রতিনিধি হিসাবে তাকে পৃথিবীতে পাঠিয়েছিলেন।

এই প্রতিনিধিত্বের ব্যাপারটিকেও আমানত হিসাবে গণ্য করা চলে, তবে এক্ষেত্রেও স্বাধীন ইচ্ছাই মূল বিষয়, কেননা এর অভাবে প্রতিনিধিত্ব ব্যাপারটাই সম্ভব নয়। এই স্বাধীন ইচ্ছা মানুষকে ‘আমি’তে রুপান্তরিত করেছে যে দায়িত্ব নিতে পারে এবং তা অস্বীকারও করতে পারে। মূলত তার অস্বীকৃতির মধ্যে তার আমিত্ব আরো বেশী ফুটে উঠে। এ কারনে নজরুল বার বার ‘আমি’-র এই দিকটিকেই মূলত: ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন, আর একারনেই কবিতার নাম হয়েছে ‘বিদ্রোহী’।

বিদ্রোহী কাব্যের আঙ্গিক তথা প্রকাশভঙ্গী সম্পর্কে একটু আগেই আমি ইঙ্গিত দিয়েছি যে তা কুরআনের সঙ্গে নজরুলের আশৈশব পরিচয়ের ফল। যে কোন বিচারে বিষয়টিকে খুবই স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু কুরআন থেকে ‘বিদ্রোহী’ কাব্যটির উপযুক্ত ভাবটি চয়নের ব্যাপারটিতে কিছুটা অস্বাভাবিকতা রয়েছে। ব্যাপারটা অস্বাভাবিক এই জন্য যে কুরআন ও তার দর্শন সম্পর্কে একাডেমিক শিক্ষা না থাকলে ভাবটি ধরা মোটেই সহজ নয়। নজরুলের পক্ষে এটা সম্ভব হয়েছিল যে কারণে তা হচ্ছে নজরুল ফারসী সাহিত্যে কিছুটা জ্ঞান লাভ করেছিলেন এবং সেই সূত্রে রুমীর মসনভী থেকে এই ভাবের ছিটেফোটা কিছুটা ধারনা পেয়েছিলেন এবং নিশ্চিতভাবেই তাঁর সমকালীন উপমহাদেশের কবি ইকবাল থেকে পেয়েছিলেন এই ভাবের একটি পূর্ণ ধারণা। পূর্বোল্লেখিত কুরআনের আয়াতটি যে এক ‘স্বাধীন ব্যক্তিত্বের’ স্বীকৃতি (ঋৎবব ঢ়বৎংড়হধষরঃু), ইকবাল শুধু তা নির্দেশই করেননি, ইতিপূর্বে পারশীভাষায় রচিত ‘আশরারে খুদী’ নামক একটি বিখ্যাত কাব্য গ্রন্থে তিনি তা তুলেও ধরেছিলেন অত্যন্ত দক্ষতার সাথে। আশরারে খুদী প্রকাশিত হয়েছিল ১৯১৪ সালে, আর বিদ্রোহী ১৯২২ সালে, দুটোর মধ্যে যোগসূত্র তাই অলীক কল্পনার ব্যাপার নয়, বিশেষত: যেখানে নজরুলের কাব্যটির সবচাইতে দৃষ্টি-আকর্ষনকারী দিক হচ্ছে ‘আমির’ বার বার ব্যবহার। এটা ইকবালের খুদী দর্শনেরই স্বীকৃতি, যার মূল আবার নিহিত কুরআনে।

৩.

কেন ইকবাল এবং নজরুল খুদী-দর্শনকে তাঁদের কাব্যের উপজীব্য হিসাবে নিয়েছিলেন? এর উত্তর হলো, মুসলমান হিসাবে এটাই ছিল তাঁদের পক্ষে স্বাভাবিক, কেন না, ইসলামী দর্শনের সূত্রপাতই ঘটেছিল মানুষের স্বাধীনতা, তথা তার ইচ্ছার স্বাধীনতা নিয়ে। পুরোপুরি ভাবে গ্রীক দর্শনে আতœনিয়োগ করার পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম চিন্তাবিদরা এই সমস্যাটির পুঙ্খানুপুঙ্খ দিক নিয়ে আলোচনা করেছিলেন এবং এই ধারা চালু থাকলে পাশ্চাত্য দর্শনের প্রভাবমুক্ত দর্শন তথা অধিবিদ্যার একটি স্বতন্ত্র ধারা হিসাবে মুসলিম দর্শন প্রতিষ্ঠা পেতে পারতো বলে অনেকেই এখন মনে করেন। ইকবালের স্বপ্ন ছিল এটাই, আর নজরুল কোন দার্শনিক উচ্চাকাঙ্খার বশবর্তী না হয়েও এই দর্শন কর্তৃক আকর্ষিত হয়েছিলন প্রবলভাবে এর সাহিত্যিক সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করে। এই উপলব্ধিটা তাঁর এসেছিল খুব সম্ভব এই ঘটনা থেকে যে স্বয়ং কুরআন বিষয়টিকে তুলে ধরেছে কাব্যিক তথা সাহিত্যের আমেজ সৃষ্টি করে। মানুষের পতনের সেই অত্যন্ত পরিচিত গল্পটি বর্ণনা করতে গিয়ে কুরআন অবশ্য মানুষকে ইচ্ছাবৃত্তি প্রদানের ফলে তার মাঝে যে একটি ‘বিদ্রোহী’ চেতনার সৃষ্টি হয়েছিল সে কথাই বলেনি, এর যে একটি সু-গভীর তাৎপর্য রয়েছে সেটার ও ইঙ্গিত দিয়েছে। কুরআনের ভাষায়ঃ

যখন তোমার প্রভু ফেরেশতাদেরকে বললেন, নিশ্চয়ই আমি পৃথিবীতে আমার প্রতিনিধি পাঠান, তারা বলল, ‘আপনি কি সেখানে এমন কাউকে পাঠাবে যারা ঝগড়া ফ্যাসাদ করবে এবং রক্তপাত করবে, অথচ আমরা আপনার প্রশংসাসহকারে তাসবীহ পাঠ করি এবং তোমার পবিত্রতা ঘোষনা করি।’ তিনি তখন বললেন, নিশ্চয়ই আমি যা জানি তোমরা তা জাননা।’ ফেরেশতাদের এ না জানা বিষয়গুলোরই একটাকে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদেরকে অবহিত করেছিলেন, যা হচ্ছে জ্ঞানের দিক থেকে মানুষের উচ্চতর অবস্থান। তিনি একটি সরল পরীক্ষার মাধ্যমে তা প্রমান করেও ছাড়লেন। আর এখানেই মনে হয় শুরু হলো এক সুদূর প্রসারী বিপত্তির। আপন শ্রেষ্ঠত্ব সম্পর্কে জ্ঞাত হয়ে মানুষ সহসা তার শক্তিও সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠে। তার মধ্যে সৃষ্টি হয় এক অপূর্ব চাঞ্চল্যের যা শয়তান তথা অশুভ এক শক্তির প্ররোচনায় উন্মাদনার রুপ লাভ করে। এরি ফল হলো বিদ্রোহ স্বয়ং বিধাতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ দিয়ে যার শুরু। এখানে উল্লেথ্য যে, শয়তান নিজেও এক বিদ্রোহী যে তার অহং বোধ এর কারনেই বিধাতা কর্তৃক চির অভিশপ্ত।

আল্লাহ কিন্তু এই বিদ্রোহ সত্ত্বেও মানুষকে ক্ষমা করেছেন, কেননা তিনি তার এ সৃষ্টিকে সত্যিই ভালবাসেন। আর যাকে ভালবাসা যায় তার প্রথম অপরাধ তো ক্ষমারযোগ্য অবশ্যই। একই সঙ্গে কুরআনে আল্লাহর প্রতিনিধি (জগদীশ্বর) হিসাবে মানুষের দায়িত্বকে অক্ষুন্ন রেখেছে। তবে এই পর্যায়ে মানুষের দায়িত্বকে অধিকতর জটিল করা হয়েছে এই অর্থে যে পৃথিবীতে তাকে শয়তানের সঙ্গে অনবরত যুদ্ধ করতে হবে এবং তার প্রতিটি কাজের সঙ্গে প্রতিদান স্বরুপ পুরস্কার কিংবা শাস্তির ব্যবস্থা থাকবে। এই ব্যবস্থায় মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার সামর্থ পুরোপুরিই অটুট থাকছে যদিও শাস্তির ভ্রুকুটি দ্বারা একে কিছুটা নিয়ন্ত্রনে রাখার চেষ্টা করা হয়েছে।

নব ব্যবস্থায় মানুষের কর্ম পদ্ধতি কি হবে? কবি এ ব্যাপারে কুরআনিক চিন্তা চেতনার মূল সুরটি সঠিকভাবে ধরতে পেরেছেন। এই পদ্ধতির ভিত্তি হচ্ছে পৃথিবীতে প্রেম ও ন্যায়ের যুগপৎ প্রাধান্য প্রতিষ্টা করা। কোমলতা ও কঠোরতার প্রতীক এ দুটো ‘ক্রিয়ার’ মূল কিন্তুু নিহিত স্রষ্টার প্রকৃতির মাঝেই যিনি ক্ষমা করেন এবং সবাইকে তার কাজের জন্য প্রতিদান (আনন্দ কিংবা বেদনা যাই প্রাপ্য হয়) প্রদান করেন। স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসাবে মানুষও তাকেই অনুসরন করবে এটাইতো স্বাভাবিক আর এটাইতো তার প্রকৃত পরিচয় যা জানতে পেরে সে হর্ষোম্মাদ হয়ে উঠে। তার প্রেমের ভুমিকা আচঁ করতে পেরে তার অনুভুতিজাগে

‘আমি সহসা আমারে চিনেছি, আমার খুলিয়া গিয়াছে সব বাঁধ।’

অপর পক্ষে ন্যায় প্রতিষ্টায় তাঁর কঠিন ভূমিকাও তাকে একই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে শেখায়ঃ জগদীশ্বর আলী পুরুষোত্তম সত্য আমি তালীয়া তালীয়া মানিয়া ফিরি এ স্বর্গ পাত্তাল মর্ত্য ।

আমি উম্মাদ, আমি উম্মাদ

আমি চিনেছি আমার

বস্তুত: সমগ্র বিদ্রোহী কবিতাটিই এই দ্বিবিধ উম্মত্ততারই এক কাব্যিক প্রকাশমাত্র। কিন্তু প্রেম ও ন্যায়তো একই মূদ্রার এপিঠ ওপিঠ। বিদ্রোহীর ন্যায়ের সংগ্রাম তাই প্রেমেরই অন্য একরুপ। তাকে তাই শান্তি প্রতিষ্টার উদ্দ্যেগকে সফল করার জন্যই বিশ্বকে নি:ক্ষত্রীর করার হুমকি দিতে হয় অথবা যাবতীয় উৎপীড়নের বিরুদ্ধে তার অবস্থানের কথা ঘোষণা করতে হয়ঃ

মহা বিদোহী আমি রনক্লান্ত সেইদিন হবো শান্ত যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রোল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না অত্যাচারীর খড়গদ্বপান ভীম রনভূমে রনিবে না।

এ পর্যায়ে বিদ্রোহীর কাজের সফলতা সম্পর্কের সন্দেহ জাগে। কেন না সে রনক্লান্ত। তার পক্ষে অত্যাচারীর তথা অন্যায়কারীর অস্ত্র প্রতিহত করা সম্ভব হবে, কবির শক্ত আশাবাদ সত্ত্বে ও, তা বিশ্বাস করা যায়না। বস্তুত মানুষ তার ভারবহনে যে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে কুরআনের সেই মন্তব্যই কিন্তুু শেষটায় কবির মন্তব্যেও প্রতিফলিত হয়। এ ব্যর্থতার অবশ্যম্বাবী ফল হলো, মাঝে মাঝে তার পদস্ফলন যা বিধাতার বুকে পদাঘাতেরই শামিল। তাই তার সর্ব শেষ আর্তচিৎকার:

আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দেই পদচিহ্ন

আমি স্রষ্টা-সুদন শোকজ্ঞান হারা খেয়ালী বিধির বক্ষ কবির ভিন্ন

আমি বিদ্রোহী ভৃগু ভগবান বুকে এঁকে দিব পদচিহ্ন।

সন্দেহ নেই প্রতিজ্ঞাটি খোদার প্রতিনিধির পক্ষে খুবই অস্বাভাবিক কিন্ত অপ্রত্যাশিত নয়। স্বাধীন ইচ্ছার সুযোগে হতাশ মনের স্বগদোক্তিগুলো এখানে আবেগের আতিশয্যা নিয়ে তুলে ধরেছেন কবি। কবি বলেই তিনি এটা পেরেছেন। কেন না, যেমন কুরআনে ইঙ্গিত করা হয়েছে, স্বভাবের দিক থেকে কবিরা অর্ধ-উম্মাদ বই নয় ।

৪.

নজরুল তাঁর সমকালীন এক কবি মোহিতলাল মজুমদারের একটি লেখার ভাব নিয়ে কবিতাটি লিখে ছিলেন বলে খোদ কবির অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু দুটি লেখা এক সাথে নিয়ে বিচার করলে বোঝা যায় সৃজনশীলতার দৃষ্টিকোন থেকে নজরুলের বক্তব্য যে একটি বড় মাপের বিষয় তা মোহিতলাল অনুধাবন করতে পারেননি। শুধু মোহিত লাল কেন, ইসলামী তথা সেমেটিক সাহিত্য সংস্কৃতির সঙ্গে যোগ না থাকায় মোহিতলালের দাবীর বিপক্ষে যারা বক্তব্য রেখেছেন তাঁদের পক্ষেও প্রকৃত সত্যটি উপলব্ধি করা সম্ভব হয়নি। ব্যাপারটা অবশ্য নজরুল নিজেই কঠিন করে তুলে ছিলেন। কবিতাটিতে তিনি এতবেশী ভারতীয় তথা হিন্দু পুরান ও রুপকল্প ব্যবহার করেছেন যে অনেক পন্ডিত ব্যাক্তি ও কবিতাটির মূল বক্তব্য বিষয়ে বিভ্রান্তির শিকার হতে পারেন। অবশ্য নজরুলের পক্ষে এর অন্যথা করা ছিল সত্যিই অসম্ভব। বাংলা সাহিত্যে উদীয়মান এক তরুন মুসলিম কবি প্রথম থেকেই তাঁর চার পাশে পেয়েছিলেন এমন একটি পরিবেশ যেখানে হিন্দু সাহিত্যিকদের ছিল অপ্রতিহত প্রভাব ও প্রতিপত্তি। সেই পরিবেশে সাহিত্যের জগতে কলকে পেতে হলে তাঁদের প্রকাশভঙ্গী গ্রহণ করা ছাড়া তাঁর পক্ষে আর কোন উপায় ছিলনা। কিন্তু নজরুল এই করে খুব বেশী একটা লাভবান হয়েছেন তা বলা যায়না।

এখানে একটি কথা না বললেই নয়, আর তা হচ্ছে ‘বিদ্রোহীর’ ভাষায় ভারতীয় পৌরানিক ঐতিহ্যের যে প্রতিফলন দৃষ্টি হয় তা কিন্তুু কখনো কবিতাটির মূল বক্তব্যের অংশ হিসাবে পরিবেশিত হয়নি, এগুলো তার অবয়বকে পরিপুষ্ট করেছে এবং মূল বক্তব্যকে শানিত করেছে। কিছু কিছু রুপকল্প বাহ্যিকভাবে ভারতীয় রুপে পরিবেশিত হলেও চরিত্রগতভাবে যাবনিক। ‘বিদ্রোহী’র একটি খুবই সুন্দর একটি চরন হচ্ছে, ‘মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাশরী আর হাতে রনতুর্য।’ অত্যন্ত স্বাভাবিকভাবেই এখানে রাধাকৃষ্ণের উপখ্যানটির কথাই সকলের মনে হবে। কিন্তু এর সূত্র হচ্ছে রুমীর মসনভী; যাঁরাই রুমী সম্পর্কে কিছু খোঁজ খবর রাখেন তাঁদের তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। সুফি ও দার্শনিক কবি জালালউদ্দিন রূমী বাঁশীর সুরকে তুলনা করেছেন, যে কঞ্চি দিয়ে বাঁশীর সৃষ্টি, মূল বাঁশের জন্য তার বিচ্ছেদ বেদনার আকুতি হিসাবে। উপমাটি সুফি সাহিত্যে এতই পরিচিত যে তা নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা না করলেও চলে।

কুরআনে ব্যবহৃত সেমেটিক উপখ্যানটিই যদি ‘বিদ্রোহী’ কবিতার সূত্র হয়ে থাকে তাহলে একটি প্রশ্ন বেশ জোরে শোরেই উত্থাপন করা চলে, আর তা হচ্ছে, উক্ত গল্পে শয়তানের একটি ভূমিকা রয়েছে বিদ্রোহীতে তার কোন উল্লেখ নেই কেন? প্রশ্নটি তাৎপর্যপূর্ণ, যদিও এর উত্তরও অত্যন্ত সোজা। শয়তান নিজেও কিন্তুু একজন বিদ্রোহী, এবং সেটা স্বাধীন ইচ্ছা জনিত কারণেই। তবে শয়তানের বিদ্রোহের প্রকৃতি সর্বোতভাবে ‘আতœসর্বস্ববাদী’ এবং নেতিবাচক। সে এখন মানুষের কুমন্ত্রনাদাতা, যে তার ইচ্ছা শক্তির দৌর্বল্যের সুযোগ নেয়। নজরুলের ‘বিদ্রোহীর’ মাঝে ইচ্ছা শক্তির যে প্রাবল্য দেখা যায় তার একটা ব্যাখ্যা হতে পারে মানুষকে তার শত দুরন্তপনা সত্বেও শয়তান থেকে ভিন্ন দৃষ্টিতে উপস্থাপন করা। এইদিক থেকে শয়তানকে এড়িয়ে গিয়ে তিনি যথার্থ দার্শনিক মানসিকতারই পরিচয় দিয়েছেন বলা চলে।

একথা অবশ্য স্বীকার করতে হবে, বিদ্রোহীতে বিস্তর বাড়াবাড়ি রয়েছে যা তাকে একজন ‘চড়াগলার কবি’ রুপে অনেকের কাছে পরিচিত করেছে। কিন্তু কবিতার বিষয়বস্তুু যত দুর্লভ ও অভিনব হবে, একজন অতিসংবেদনশীল কবির আবেগের মাত্রাও তো সেই অনুপাতেই উর্ধগামী হতে পারে। এখানে অস্বাভাবিকতা কিছু নেই। যা দেখতে হবে তা হচ্ছে, কবিতার বিষয়বস্তুুটি দার্শনিক বৈশিষ্ট প্রদর্শন করে কিনা। এই বিচারে বিদ্রোহী কবিতায় নজরুলকে একজন দার্শনিক কবি হিসাবে অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।

এ পর্যায়ে আরো একটি কথা উল্লেখ করতে হয় যা হচ্ছে, ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটিতে শুধু একটি দার্শনিক বিষয়কে তুলে ধরাই নজরুলের উদ্দেশ্য ছিলনা, একটি সেমেটিক জীবন-দর্শনকে ভারতীয় তথা আর্য-ভাষায় প্রকাশের মাধ্যমে তিনি একটা চমকও সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন; হয়ত দুটো জীবন ধারার মধ্যে একটি সমন্বয় সাধনের সুপ্ত আকাঙ্খাও তার মধ্যে ছিল। এ ব্যাপারে যে তিনি বেশ সাফল্য প্রদর্শন করেছেন তাতে কোন সন্দেহ নেই। শুধু কবিতায় নয়, কবি তার ব্যক্তিগত জীবনেও এই সমন্বয়ের চেষ্টা করেছেন। আমরা বলতে পারি আজকে যাঁরা সমন্বয়ী জীবন দর্শনের কথা বলেন তাঁদের মনের কথাটি তিনি বহু আগেই ধরতে পেরেছিলেন। এতদসত্ত্বেও আশ্চর্য্য হতে হয়, যখন বলা হয় নজরুলের কবিতা ‘গভীরতায় ঃআধুনিক কালে প্রাজ্ঞ আত্মজিজ্ঞাসু মনকে কদাচিৎ তৃপ্ত করে’ অথবা শুনতে হয়, ‘নজরুলের কবিতায় ‘মহৎমান’ নেই এবং মহাকবির গভীর প্রসাদ নেই।’ শুধু তাই নয়, ‘বিদ্রোহীর’ মূল সূত্রটি ধরতে না পেরে নজরুলকে এই অভিধায় চিহ্নিত করাকেও অনেকে তার প্রতি অবিচার বলে মনে করেছেন । সময় এসেছে , তাই নজরুলকে নিয়ে নতুন করে ভাবার।

-----
সূত্র: ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী ২৮ মে ২০১০

No comments:

Post a Comment