Thursday, July 8, 2010

ভাষার শুদ্ধ ব্যবহারে এত অবহেলা কেন - আহমদ রফিক

বিশেষ করে বিনোদনের এসব মাধ্যম তরুণদের খুবই প্রিয়। স্বভাবতই টিভি’র অনুষ্ঠানে অশুদ্ধ শব্দ ব্যবহার বা ভুল বানান লেখার গুরম্নত্ব অস্বীকার করা চলে না। কিন্ত্ত টিভি পরিচালকগণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, যেমন ঘামান না ‘টক-শো’ বা ‘বিতর্ক অনুষ্ঠানের’ বক্তা। তারা তাদের মত করেই বলেন, যেমন বলেন সংসদ অধিবেশনে সাংসদগণ। তাদের উচ্চারণ শুনলে মাথা ধরে যায়

আমরা বাঙালি। বাংলা আমার মাতৃভাষা। রাষ্ট্রভাষা আমাদের বাংলা।’ বিষয় তিনটে নিয়ে আমাদের শিক্ষিত শ্রেণীর তরম্নণদের মধ্যে গর্ব ও অহংকারের প্রকাশ যথেষ্ট। অবশ্য সঙ্গত কারণে। পাকিস্তানি আমলে অনেক লড়াই করে রাষ্ট্রভাষার অধিকার অর্জন, রীতিমত যুদ্ধ করে অনেক মৃত্যু, অনেক ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা-এ সবই এখন ইতিহাস। এবং ভাষার প্রতি, জাতীয়তাবোধের প্রতি মমত্বের প্রকাশ।

তা সত্ত্বেও মাতৃভাষার প্রাত্যহিক নানামাত্রিক ব্যবহারে, সাংস্কৃতিচর্চার নানা ক্ষেত্রে ভাষা বিষয়ক গর্ব ও অহংকারের জায়গাটা আমরা পায়ে মাড়িয়ে চলি কেন? আমাদের ভাষিক সমাপনে ঐ গর্বের প্রতিফলন ঘটে না কেন? স্বভাবতই প্রশ্ন: ভাষার নানামাত্রিক অশুদ্ধ ব্যবহার কি ভাষার প্রতি শ্রদ্ধা বা মমতার পরিচায়ক?

ভাষার অশুদ্ধ ব্যবহার আমরা হরহামেশা দেখি কথাবার্তায় বা আলোচনায়, টিভি’র অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় (শেষোক্তটি কলকাতায় এন্তার) বাংলা-ইংরেজির মিশ্রণে, শব্দের যথেচ্ছ ব্যবহারে, বিস্তর বানান-ভুলের অনাচারে আমার ধারণা মাতৃভাষার প্রতি অবহেলা এর অন্যতম প্রধান কারণ। অবশ্য এর জন্য শিক্ষণ ও শিক্ষাদানের দায় অনেক, বিশেষত শব্দ ব্যবহার, উচ্চারণ ও বানানে। শিক্ষার প্রাথমিক পর্যায়ে শিক্ষার মান, শিক্ষাদানের গুণপনার দিকে তাকালে তাই মনে হয়। তবে তা রাজধানীর তুলনায় ঢাকার বাইরে অনেক বেশি। কচি বয়সে কাঁচা মনে যা একবার দাগ কাটে তা সহজে মুছে যাবার নয়।



তবু অবহেলার কারণটাই আমার কাছে বড় মনে হয়। অনেকটা ঐ প্রবাদ বাক্যের মতো যে ‘ঘর কা মুরগি ডাল বরাবর’। অথবা গ্রামে প্রচলিত কথার মতো :‘বাড়ির গরম্ন ঘাটার ঘাস খায় না’-দূরের ঘাসই তার পছন্দ। মাতৃভাষা নিয়ে এ জাতীয় মনোভাব যুক্তিসঙ্গত মনে হয় না, মেনে নিতে কষ্ট হয় বিশেষ করে যখন মাতৃভাষার জন্য লড়াইটা মিথ্যা নয়। কিন্ত্ত ঘটনার বাস্তবতা বলে, এটাই সত্য। হয়তো আমরা ভাবি, বাংলা তো আমার মায়ের বুলি, ভাষা যত্ন করে, পরিশ্রম করে শিখতে হবে কেন? আপ&সে আপ& আয়ত্তে এসে যাবে। এমন ধারণা ভুল। মাতৃভাষাও যত্নে, শ্রমে, মমতায় শিখতে হয়।

কথাটা অপ্রিয় সত্য যে, বাংলার তুলনায় আমরা ইংরেজিকে অনেক মান্য করি (অন্য বিদেশী ভাষাকে তেমন করি না)। বাংলায় কথা বলতে গিয়ে বা বক্তৃতায়-ভাষণে-আলোচনায় ইংরেজির বিস্তর মিশেল এনে উদ্ভট মিশ্র ভাষার জন্ম দিচ্ছি। টিভি অনুষ্ঠানে বা কোনো কোনো বেতার প্রচারে বিচিত্র মিশ্র বাংলার প্রচলন সত্যই দুঃখজনক। টিভি চ্যানেলের ‘টক-শো’ বা বিতর্ক অনুষ্ঠানের দিকে তাকালে তা ভালো বোঝা যাবে। ‘এবার একটা ‘ব্রেক’-কেন? ‘বিরতি’ কী দোষ করেছে। এসব ক্ষেত্রে দায় উপস্থাপদের চেয়ে বক্তার অনেক অনেক। আমাদের শিক্ষিত সমাজের একাংশে এই যে উদ্ভট মিশ্রভাষার নির্বিচার বয়ান তা যে মাতৃভাষা বাংলার পক্ষে গৌরবজনক নয় এবং তা যে আমাদের গভীর ভাষা বোধেরও পরিচায়ক নয় এ সত্য আমরা জানি। কিন্ত্ত জেনেও বুঝতে চাই না। বরং ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলায় যেন এক ধরনের আভিজাত্যবাধের প্রকাশ ঘটে। এর কারণে অবশ্যই পৌনে দু’শ বছরের ইংরেজ শাসনের সামাজিক প্রভাব, যে-প্রভাব বিদেশী শাসনমুক্ত স্বদেশে স্বশাসনেও দূর হয়নি। ভাষিক জাতীয়তা বোধের সাংস্কৃতিক চর্চা সত্ত্বেও ঐ দাস মনোভাবের অবসান ঘটেনি। বরং নানাভাবে এ ধরনের আচরণ যুক্তিবৃদ্ধ করার চেষ্টা চলে।

দুই

আমাদের জীবনে গণমাধ্যম, প্রচার মাধ্যমের গুরম্নত্ব যথেষ্ট। তরম্নণদের মধ্যে, তাদের জীবনাচারে এসবের প্রভাব অনেক। বিশেষ করে বিনোদনের এসব মাধ্যম তরম্নণদের খুবই প্রিয়। স্বভাবতই টিভি’র অনুষ্ঠানে অশুদ্ধ শব্দ ব্যবহার বা ভুল বানান লেখার গুরম্নত্ব অস্বীকার করা চলে না। কিন্ত্ত টিভি পরিচালকগণ এসব নিয়ে মাথা ঘামায় না, যেমন ঘামান না ‘টক-শো’ বা ‘বিতর্ক অনুষ্ঠানের’ বক্তা। তারা তাদের মত করেই বলেন, যেমন বলেন সংসদ অধিবেশনে সাংসদগণ। তাদের উচ্চারণ শুনলে মাথা ধরে যায়। অবশ্যই এ অভিযোগ সবার বিরম্নদ্ধে করা চলে না। জনপ্রতিনিধিরা জনগণের ভাষায় কথা বলবেন মাঠে ময়দানে, জনসভায়, জনগণের সঙ্গে কথাকতায়, সংসদে নয়।

বছর কয় আগে টিভি’র এক সংবাদ পাঠককের কণ্ঠে ‘দারিদ্রতা’ শব্দটি বারকয়েক শুনে অবাক হয়েছিলাম। তেমনি শিক্ষিত অনেকের কথায় বা বক্তৃতায়, বিশেষত রাজনীতিকদের কণ্ঠে শোনা যায় ‘দারিদ্রতা’ দৈন্যতা’র মতো শব্দাবলী। তরম্নণ শিক্ষার্থীরা হয়তো ভাববেএগুলোই নির্ভুল- কী শব্দ, কী বানান। কারণ ঐসব বক্তা তো উচ্চশিক্ষিত, নমস্য!

আমরা ধরে নেই কবি, গল্পকার, প্রাবন্ধিক নির্ভুল বাংলাই লেখেন। কিন্ত্ত আপনি যদি কোনো সাহিত্য পত্রিকার সম্পাদক হন তাহলে আপনার অভিজ্ঞতা ভিন্ন কথা বলবে। অন্তত সাহিত্য অঙ্গনে এমন লেখকও আছেন নবীব ও আধুনিক, যারা আপন খেলায় খুশী মতো লেখেন। কেউ কেউ শব্দ নির্বাচনে নৈরাজ্যবাদী, আর বানান-সেক্ষেত্রে অভিধান অগ্রাহ্য করাই রীতি অথবা আধুনিকতা। তাই অভিধান মানার প্রয়োজন বোধ করেন না। এর মধ্যে নতুন সমস্যা প্রমিত বাংলা বানান নিয়ে বিতর্ক। আমি এক ভাষাবিদ অধ্যাপককে জানি যিনি অধিকাংশ কথিত প্রমিত বানান অগ্রাহ্য করে বেশ কিছু শব্দে দীর্ঘ ঈ ব্যবহারের পক্ষে। অভিধানে একদা স্বীকৃত সেই দীর্ঘ ‘ঈ’-র পক্ষে তার অনেক যুক্তি। আরেক ভাষাবিজ্ঞানী প্রমিত বাংলার টানে এতটাই বিশ্ব্বাসী যে তিনি ‘ণ-ন’ র তফাৎ ঘুচিয়ে দিতে চান এবং দীর্ঘ স্বরের ব্যবহার মানতে একেবারে নারাজ, এমনকি ইংরেজি দীর্ঘ উচ্চারণও-যেমন গ্রীস (
Greece), লীগ (League) ইত্যাদিতে। আনন্দবাজার গোষ্ঠীর হাঁটাপথে আমাদের এখানেও অনেক পত্রপত্রিকায়, বিশেষত দৈনিকপত্রে চিন (চীন), লিগ (লীগ), গ্রিস (গ্রীস) অনায়াস স্বীকৃত পেয়ে গেছে। এ বিষয়টি পরে বিবেচ্য।

কোনো কোনো শব্দের অশুদ্ধ ব্যবহার ঢাকা-কলকাতার সাহিত্যে (গল্প-উপন্যাস-প্রবন্ধে) এতটা জলচল হয়ে গেছে যে যুক্তির সমর্থন সত্ত্বেও প্রশ্ন তোলা বিপজ্জনক মনে হতে পারে। এসম্বন্ধে দু-চারটে উদাহরন অপ্রাসঙ্গিক হবে না। যেমন ‘ফলশ্রম্নতি’ ‘প্রেক্ষিত’ ‘চিন্তা-চেতনা’ ‘মন-মানসিকতা’ ইত্যাদি। চিন্তা ও চেতনার মধ্যে কোথায় অর্থগত মিল যে তাদের হাত ধরাধরি করে চলতে হবে?

অন্যদিকে অভিধান-মতে ‘ফলশ্রম্নতি’ শব্দটির অর্থ শ্রম্নতির ফল অর্থাৎ ‘পুণ্যকাহিনী শ্রবণে যে ফল পাওয়া যায় তাই ফলশ্রম্নতি, ঃঅতএব ফলশ্রম্নতি হচ্ছে পুণ্য অর্জন। অথচ ফল তা ফলাফল অর্থে ফলশ্রম্নতি’র ব্যবহার নামীদামীদেরও কলমে, শব্দের মূল অর্থ বিবেচনা না করে। আর ঐ এন্তার ব্যবহারের কারণেই কি আমাদের দেশী অভিধানে দ্বিতীয় অর্থ হিসাবে ফলাফল জায়গা করে নিয়েছে?

টিভি উপস্থাপকের মোলায়েম কণ্ঠে সর্বদা উচ্চারিত (এমন কি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উপস্থাপকের কণ্ঠেও) ‘সুপ্রিয় দর্শক-শ্রোতা’ শব্দগুলোর সঙ্গে আমরা ভালোভাবেই পরিচিত। কিন্ত্ত ‘সুপ্রিয়’ শব্দটি যে অশুদ্ধ এবং প্রচলিত বলে অভিধানে অন্তর্ভুক্ত এমন তথ্য অভিধানের ভাষ্যে জানা গেলেও এ নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথা নেই।

একই ভাবে পরিপ্রেক্ষিত অর্থে ‘প্রেক্ষিত’ শব্দটি হর হামেশা ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে মননশীল সাহিত্যিক সাংবাদিক এক কাতারে। দৈনিক পত্রের খবরে, কলমে, প্রতিবেদনে বা সাহিত্যের বিভিন্ন ধরনের লেখায় বিশেষ করে প্রবন্ধে ‘প্রেক্ষিত’ শব্দটির ব্যাপক ভুল ব্যবহার দেখা যায়। অথচ অভিধানিক অর্থে ‘প্রেক্ষণ’ বলতে দর্শন, ‘পর্যবেক্ষণ’ বোঝায়। সেই প্রেক্ষণ থেকে ‘প্রেক্ষিত’ শব্দের অর্থ হচ্ছে ‘দর্শন বা প্রেক্ষণ করা হয়েছে এমন।’ তা সত্ত্বেও শব্দটি বহুব্যবহƒত বা প্রচলিত বলেই বোধ হয় ‘প্রেক্ষিত’-এর অর্থ আমাদের অভিধানে লেখা হয়েছে ‘পটভূমিকা’ (পরিপ্রেক্ষিত)। আমাদের প্রশ্ন: প্রেক্ষিত-এর অশুদ্ধ ব্যবহারের বদলে পরিপ্রেক্ষিত লিখতে অসুবিধা কোথায়? মাত্র তো দু’ট অক্ষর কম বেশী। ভুলের দিকে আমাদের এত ঝোঁক কেন, বোঝা কঠিন। অশুদ্ধ শব্দের ব্যবহার যত না তার চেয়ে অনেক বেশী আমাদের ভাষার ব্যবহারে বানান ভুল। অন্যদিকে সাহিত্যের ভাষায় প্রমিত-অপ্রমিত নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ, যথেষ্ট বিতর্ক। যেমন হ্রস্ব-স্বর বনাম দীর্ঘস্বরে তেমনি ‘ণ’-‘ন’-য়ের দ্বন্দ্বে। এমনকি চন্দ্রবিন্দু লোপাট করার নৈরাজ্যে। কলকাতার আনন্দবাজার গোষ্ঠী একসময় মর্জিমতো বানান লেখা শুরম্ন করে তাদের পত্র-পত্রিকায়। দীর্ঘদিন পর দেখছি আমাদের দৈনিক পত্রিকায়ও বানানের স্বৈরাচার-ঐ হ্রাস্ব-দীর্ঘস্বর ব্যবধান ঘুচিয়ে এবং চন্দ্রবিন্দু বর্জনের মতো ঘটনায়।

কিন্ত্ত যুক্তিহীন এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য নয় কোনোমতেই। চন্দ্রবিন্দু লোপাটের ঘটনার প্রসার ঘটলে কাটা (কাঁটা) ও কাটার অর্থ বুঝতে শিক্ষার্থী হোঁচট খাবে। কষ্ট হবে পাক (পাঁক) ও পাক, কাচা (কাঁচা) ও কাচার ভেদ বের করতে। এমন অনেক শব্দ বানান অনাচারের শিকার হয়ে সমস্যা তৈরি করবে।

শব্দের ব্যবহার, বানান রীতি, বাক্য গঠন ইত্যাদি ক্ষেত্রে ‘ব্যাকরণ মানিনা’র মতো গোর্য়াতুমি ‘নন সেন্স রাইমে’ চলতে পারে সৃজনধর্মী বা মননধর্মী রচনায় একেবারেই অগ্রহণযোগ্য। কোনো কোনো অভিধানেে অশুদ্ধ কিন্ত্ত প্রচলিত’ এমন যুক্তি হালে পানি পাওয়ার কথা নয়। কখনো প্রমিত বাংলার কখনো আধুনিকতার দোহাই দিয়ে ভাষার মর্জিমাফিক ব্যবহার নতুন করে ভাষা বিতর্কের জন্ম দেবে যার সমাধান কখনো মিলবে না। কথাটা সংশ্লিষ্ট সবাইকে ভেবে দেখতে বলি। তবু এসব নিয়ে তর্কবিতর্ক চলতে পারে কিন্ত্ত বিজ্ঞাপনে, ব্যানারে, হোডিং-এ, রাস্তার দু’ধারে বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট, প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে বিচিত্র বানান ভুলের যে প্রদর্শনী তা শুধু চোখের পীড়াই নয় ভাষার প্রতি চরম অবহেলার প্রকাশও ঘটায়। ঢাকার পথে-ঘাটে মনোযোগ দিয়ে ডানে-বায়ে তাকালে অজস উদাহরণ মিলবে।

উদাহরণ স্বরƒপ আমার দেখা কয়েকটা শব্দ উদ্ধার করা হলো-স্বরণী, স্মরণী, (সরনি অর্থে), বিথিকা, শুভাসিনি, পন্য, শ্রদ্ধাঞ্জলী, নিরব, সল্পমুল্যে ইত্যাদি। দিনের পর দিন পথ চলতে এ ধরনের বানান দেখে দেখে কেউ কেউ হয়তো এগুলোকেই সঠিক বানান বলে মেনে নেবেন, বিশেষ করে তরম্নণ শিক্ষার্থী যারা বানান নিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন কিংবা অভিধান দেখতে যাদের গায়ে জ্বর আসে। এমন কিছু ভেবে ভুলের মহড়া দেখে মাঝে মাঝে মনে হয় ভুলগুলো শুধরে দেই।

অনেক দিন আগেকার কথা। আমার এক অধ্যাপক (বাংলা সাহিত্যের) বন্ধু পন্ডিত শহীদুল্লাহ সাহেবের বাসায় গিয়ে ছিলেন কী এক কাজে। গল্প করতে করতে প্রসঙ্গক্রমে তার শিক্ষক তাকে বলেছিলেন: মাহিউদ্দিন, আর যাই কর বানান আর উচ্চারনটা ঠিক রেখো।’ জানিনা বানান বিভ্রাট নিয়ে শহীদুল্লাহ সাহেব বিব্রত হয়ে পড়েছিলেন কি না। আর আমাদের উচ্চারণে সম্ভবত ছোটবেলাকার অভ্যাসে আঞ্চলিক বা স্থানিক প্রভাবে এ্যকার উকার এবং র-ড়’ মত অনেক কিছুর এতই বিড়ম্বনা যে শুদ্ধ উচ্চারণ বড়ো কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।

উচ্চারন বিভ্রাটের তাড়ায় পথে বেরিয়ে দেখি ‘সেচ্ছায় রক্তদানের’ লাইন ‘শীববাড়ির আবাশীক’ এলাকায় পাচমিসালী মুরকী পণ্য’ মেলায় বেজায় ভীড়-মলাটে লেখা ‘রাজর্ষী’ নামের বইটার চেহারা ‘করম্নন’। আবার আগেকার কথা, ষাটের দশকের একেবারে শেষ দিকে সাহিত্য পত্রিকাটায় এত ভুল কেন প্রশ্ন করায় সাহিত্য কর্মীর (পরবর্তী কালে সাংবাদিক) তাৎক্ষনিক জবাব ‘এ রকম ভুল তো থাকবেই।’ কিন্ত্ত জীবন কি সীমাহীন ভুল সইতে পারে?

আবারও একটা ভুলের ঘটনা বলে আলোচনায় ইতি টানব। এবার আশির দশকের ঘটনা, সত্য ঘটনা। একটি জনপ্রিয় বাংলা দৈনিকের সম্পাদক পত্রিকার প্রম্নফরিডারকে বিরক্তির সুরে প্রশ্ন করেন, ‘আপনার প্রচুর সংশোধনে এত বানান ভুল থাকে কেন? অভিধান দেখে নিতে পারেন না।’ প্রফরিডারের নির্বিকার জবাব, ‘ডাইট হয় না যে স্যার, অভিধান দেখতে যাবো কেন? অর্থাৎ লেখায় ভুল, প্রম্নফরিডারের জানায় ভুল এবং সেটা এমনই যে ভুল বানানটাই তার চোখে নির্ভুল। এ রোগের ওষুধ নির্ধারণ কঠিন।

শিক্ষার গলদ, শেখার গলদ, মানসিকতায় গলদ সব কিছু মিলে শুদ্ধতার প্রতি চরম অনীহা। গোঁজামিলে সব কিছু সেরে নেওয়ার প্রবণতা। তাই দশকের পর দশক শিক্ষিতের সংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ভাষার প্রতি অমনোযোগ ও মমত্বের অভাব দিন দিন বেড়েই চলেছে। প্রমাণ মেলে রাস্তার হোর্ডিং ও বিজ্ঞাপনে, ভিন্নভাবে দর্শন মেলে গণমাধ্যমে। এর কারণ খুঁজে পেতে হবে, শুদ্ধির পথও পেতে হবে। কেন জানি মনে হয় সংক্ষিপ্ত সময়ে স্বদেশ অর্জন কি আমাদের মানসিকতায় প্রভাব রেখেছে যে আমরা গোজামিলেই সব কিছুর সমাপ্তি টানতে চাই। নিখুঁত-নির্ভুলের প্রতি আকর্ষণ নেই। কিন্ত্ত তাই বা কেন হবে?

 ....
সূত্র: ইত্তেফাক সাহিত্য সাময়িকী - ০২ জুলাই ২০১০

No comments:

Post a Comment