Monday, April 12, 2010

মেঘনাদ বধ ও অন্যান্য মহাকাব্য বিচারের ভূমিকা

মো হা ম্ম দ র ফি ক উ জ্জা মা ন

শাস্ত্রকার বিশ্বনাথ কবিরাজ, সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্র অনুযায়ী মহাকাব্যের যে আদর্শ নিরূপণ করেন সে অনুযায়ী মহাকাব্যের লক্ষণগুলো হলো, মহাকাব্যের অন্তত আটটি সর্গ থাকতেই হবে। এক একটি সর্গ একই ছন্দে রচিত হবে এবং সর্গের শেষে ছন্দান্তর ঘটবে! সর্গশেষে পরবর্তী সর্গ সম্পর্কে বর্ণনা থাকবে। প্রতিটি সর্গে বিষয়ানুগ শিরোনাম থাকা আবশ্যক। 'আশীর্ণমস্ক্রিয়া বস্তুনির্দেশনা বহপি তন্মুখম্।' অর্থাৎ মহাকাব্য শুরু হবে আশীর্বাদসহ নমস্কার ও বস্তুনির্দেশনা সহযোগে। 'ইতিহাসকথোদ্ভূতমিতরদ্ধা সদাশ্রয়ম্।' মহাকাব্যের বিষয় ইতিহাসাশ্রিত অথবা সত্য ঘটনানির্ভর হবে। 'চতুর্বর্গকলোপেতং চতুরোদাওনায়কম্।' চতুর্বর্গ ফল, অর্থাৎ ধর্ম অর্থ কাম ও মোক্ষ ফললাভের উপযোগী এবং নায়ক চতুর উদাত্তগুণসম্পন্ন সদ্বংশজাত। এভাবে মহাকাব্যের ঘটনাক্রমে থাকবে নগর, পর্বত, সমুদ্র, চন্দ্রসূর্যের উদয়, যুদ্ধ, বীরত্ব, মৃত্যু, লোকরঞ্জনসহ বিবাদ, কলহ, প্রতারণা, বিবাহ _ বিচ্ছেদ, মিলন। অলঙ্কার শাস্ত্রের সমস্ত রসাভাষ ও রসাভাস থাকবে মহাকাব্যে। তবে শৃঙ্গার, বীর অথবা শান্তরসের প্রাধান্য থাকবে।



উনিশ শতকে যে তিনজন কবিকে মহাকাব্য রচনায় উদ্যোগী হতে দেখি, তারা হলেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীন চন্দ্র সেন। এদের মধ্যে মধুসূদন সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রকে অমান্য করেই মহাকাব্য রচনায় হাত দেন। একমাত্র উপখান্যাংশ ছাড়া সংস্কৃত সাহিত্য থেকেও কোনো উপাদান গ্রহণ করেননি তিনি। উপাখ্যানাংশের চরিত্র _ চিত্রণেও তিনি মূল উপাখ্যানকে অবলীলায় অবহেলা করেছেন।

শাস্ত্রকার নির্দেশিত যে অবয়ব মহাকাব্যের জন্য নির্দিষ্ট তা তাকে আকর্ষণ করেনি। তিনি বর্ণনা, বিষয়বস্তু, পাত্রপাত্রী বিশেষত নায়কের বংশমর্যাদা, সর্গসংখ্যা ইত্যাদি অবকাঠামোর চেয়ে তার নিজের জীবন ও সমকালের উপলব্ধি দিয়েই মহাকাব্যের প্রাণ প্রতিষ্ঠায় প্রয়াসী হয়েছেন। সেই উপলব্ধি ছিল ১৯ শতকের পরাধীনতার অদৃষ্টগত নিপীড়নে যুবমানসের সংক্ষোভজাত। এক্ষেত্রে তার আদর্শ ছিল গ্রিক মহাকাব্যের অলঙ্কার শাস্ত্র। তার কাব্য ভাষা গম্ভীর শব্দ ও ছন্দ ঝঙ্কারে বিষয়বস্তুর গভীরতা, ব্যাপকতা ও বিশালতাকে মেলে ধরেছে। সংস্কৃত উপাখ্যানের কর্মদোষে দুষ্ট দেবতাদ্রোহী রাক্ষস, মধুসূদনের মহাকাব্যের আখ্যানভাগে হয়ে উঠেছে ভাগ্যবিড়ম্বিত দেশপ্রেমী যোদ্ধা নায়ক। যে নায়ক মহান ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছে মধুসূদনের জীবনোপলব্ধির সম্পূর্ণতার সংযোগ ঘটায়।

উনিশ শতকের জীবনযন্ত্রণার শিহরণ, উন্মাদনা, প্রাণোস্ফুরণকে মধুসূদন অনুভব করেছেন নিজের স্নায়ুতে। তার আত্মোপলব্ধির ক্ষোভ, ব্যাকুলতা, হতাশা, দ্বন্দ্ব, বেদনায় জারিত হয়ে 'মেঘনাদ বধ' কাব্য অনন্যতা পেয়েছে। এই মহিমা, তার সমসাময়িক বা পরবর্তীকালের কোনো কবি তাদের মহাকাব্য প্রয়াসে সঞ্চারিত করতে সক্ষম হননি। কাহিনী বিনির্মাণ, চরিত্র সৃষ্টি ও চিত্রণ, শব্দপ্রয়োগ, চরিত্রানুগ ঝঙ্কৃত সংলাপ দৃশ্য বর্ণনা, উপমা-রূপকের দক্ষ প্রয়োগ, সংশয় ও বেদনার আর্তিকে ক্রন্দনে রূপান্তরের আত্মিক উচ্চারণ ইত্যাদি কৌশল মধুসূদন আয়ত্ত করেছিলেন_ হোমার, ভার্জিল, দান্তে, মিল্টন প্রমুখের কাব্যাদর্শ থেকে। সর্বোপরি মাতৃভূমিপ্রীতি ও মানুষের পূর্ণ ব্যক্তিত্বের উদ্দীপন মধুসূদনের মতো অন্য কোনো বাঙালি মহাকাব্য রচয়িতার হাতে একেবারেই মূর্ত হয়ে ওঠেনি।

হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীন চন্দ্র সেন, জন্মসাল অনুযায়ী মধুসূদনের বয়োকনিষ্ঠ। মধুসূদনের জন্ম ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে। হেমচন্দ্র ও নবীনচন্দ্রের জন্ম যথাক্রমে ১৮৩৮ ও ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু মধুসূদনের জীবনের স্বর্ণসময় প্রথম যৌবন কেটেছে ইংরেজি কবিতা লিখে, প্রতিষ্ঠা পাওয়ার বাসনায়। বাংলা সাহিত্যের সঙ্গে তার পরিচয় ঘটে ৩৩-৩৪ বছর বয়সে এসে_ তাও নাটক রচনার মাধ্যমে। তাছাড়া অন্যসব কিছুর মতো, তিনি বেহিসাবি এবং বিশৃঙ্খলভাবে। মাত্র ৪৯ বছরে তার মৃত্যু ঘটে। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীন চন্দ্র সেন, তাদের কাব্য রচনাকালে প্রভূত পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেন, এমনকি শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবেও খ্যাত হয়েছিলেন। এ খ্যাতি অর্জনের জন্য দু'জনই সাম্প্রদায়িকতার সহজ সংকীর্ণ পথ বেছে নিয়েছিলেন। মহাকাব্য রচনায় দু'জনেরই অনুপ্রেরণা ছিল মধুসূদনের সাফল্য। হেমচন্দ্র ছন্দ হিসেবে অমিত্রাক্ষর অবলম্বন করলেও সংস্কৃত অলঙ্কার শাস্ত্রের অনুশাসন থেকে বেরিয়ে আসতে পারেননি। তার রচিত মহাকাব্য বৃত্তসংহার কাব্য অমিত্রাক্ষর ছন্দের গতি ও ঝঙ্কার সৃষ্টি এবং বাক্যকে বাচনভঙ্গির স্বাভাবিকতা রক্ষা করে যতি চিহ্ন প্রয়োগের নৈপুণ্যের অভাবে বহু ক্ষেত্রেই বহমান হয়নি। বৃত্তসংহার এর আখ্যান এসেছে।


নৃসিংহ পুরাণ থেকে পৌরাণিক কাহিনীটি এমন, বৃত্তাসুর স্বর্গ অধিকার করে নেয়। স্বর্গ পুনরুদ্ধারের জন্য দেবরাজ ইন্দ্র কুমেরু শিখরে গিয়ে তপস্যা করেন। সেই সাধনার শক্তিতে বৃত্তাসুর অর্থৎা বৃত্ত নামের অসুরকে পরাজিত এবং সংহার করেন। 'বৃত্তসংহার' একটি সুবিশাল মহাকাব্য। আয়তন, প্রেক্ষাপট, কবিকল্পনা ইত্যাদিতে মহাকাব্যের সার্থকতার সম্ভাবনা থাকলেও আঙ্গিক ও প্রকরণগত অসম্পূর্ণতার কারণে তা হয়নি। কল্পনার আতিশয্য এ কাব্যকে জীবন, সমাজ ও সমকাল সচেতন হতে দেয়নি। এটি কেবলই প্রাচীন হিন্দু গৌরবের বাখান হয়ে গেছে। তাছাড়া মহাকাব্য হয়ে ওঠার পথে আঙ্গিকগত বিশৃঙ্খলা বিভিন্ন স্থানে প্রকট হয়ে উঠেছে। মনে হয়েছে, কাব্যদেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো যথাস্থানে প্রযুক্ত হযনি এবং অঙ্গগুলো অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পূর্ণতা লাভ করেনি। বিশেষ করে ভাষার যে প্রাঞ্জল স্ফূর্ততা প্রয়োজন এর মধ্যে তা নেই, নেই উদাত্ত গাম্ভীর্য। এমনকি এ কাব্যের শব্দ ব্যবহারও তরঙ্গিত নয়, নির্জীব-শ্লথ। এ কাব্যে ঘটনার বিবরণ কোথাও কবির জীবনবোধের দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে প্রাণময়তা লাভ করেনি। তার উপমা-রূপকের ব্যবহারও দ্যুতিলাভ করেনি কোনো স্থানে। অতি সাধারণ তুলনায় স্তর পেরিয়ে তা কাব্যমূল্য লাভ করেনি। মধুসূদনের উপমা বিদ্যুৎপ্রভ। যেমন

'চমকিলা বীরবৃন্দ হেরিয়া কামারে,

চমকে গৃহস্থ যথা ঘোর, নিশাকালে

হেরি অগি্ন শিখা ঘরে।'

নৃ-মুণ্ড-মালিনী যখন দূত হয়ে রামের সম্মুখে যাচ্ছে তখন শিবিরে প্রবেশের পর তার রূপে বীরদের চমকে ওঠার বর্ণনা 'নিশাকালে অগি্নশিখা'র উপমা এভাবেই দিয়েছেন মধুসূদন।

এভাবে 'মেঘনাদ বধ' কাব্যে অসংখ্যস্থানে সার্থক উপমার অলঙ্কার, মণিরত্নের মতো ঝলক দিয়ে উঠেছে। উপমান এবং উপমেয় এখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সমধর্মী নয় বলে তা প্রতিতুলনাজাত সমস্ত অলঙ্কারকেই স্পর্শ করেছে। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে সমাসোক্তি এবং আরও প্রসারিত হয়ে চিত্রকল্পের মর্যাদা লাভ করেছে। অন্যদিকে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপমা সৃষ্টির প্রয়াস প্রকৃতভাবে উপমাই হয়ে ওঠেনি বহু স্থানে।


'বায়ুতে চঞ্চল যথা বিশুষ্ক পলাশ

রসনা তেমতি দ্রুত বিকম্পিত তার!'

বাতাসে কম্পমান শুষ্ক বস্তুর সঙ্গে রসনার কম্পনের তুলনা হাস্যকর। দ্বিতীয় উদাহরণে ভানুর 'উথলিয়া' পাড়া অনেকাংশেই উদ্ভট। এবং তৃতীয় উদাহরণে শুষ্কতার সঙ্গে গ্গ্নানির তুলনাও যথাযথ নয়।


নবীনচন্দ্র সেনের মহাকাব্য 'রৈবতক', 'কুরুক্ষেত্র' 'প্রভাস'। এ ত্রয়ী কাব্যে নবীন চন্দ্রের চেষ্টা ছিল হিন্দুধর্মীয় জাতীয়তা বোধের পুনর্জাগরণ ঘটানো। তার হিন্দু ধর্মরাজ্য প্রতিষ্ঠার কল্পনা জনপ্রিয় হয়েছিল ধর্মীয় ভেদবুদ্ধির কারণেই। এক ধর্ম-এক জাতি এ উন্মাদনা নবীন চন্দ্রকে জনপ্রিয়তা দিলেও মহাকাব্যপ্রণেতা হিসেবে সাফল্য দিতে পারেনি। তার ত্রয়ীকাব্যে যথাক্রমে শ্রীকৃষ্ণের আদি-মধ্য ও অন্ত্যলীলার প্রকাশ ঘটেছে। এই বিশাল পরিসরে আখ্যানভাগের বিশালতা ও মহাকাব্যসুলভ অন্যান্য উপাদান উপস্থিত থাকলেও শব্দের ব্যবহার গতিময় না হওয়ায় এবং উপমা-রূপক সৃষ্টির দুর্বলতা থাকায় কাব্যশৈলী মারাত্মকভাবে উৎকর্ষ হারিয়েছে। মূলত মহাকাব্যোপযোগী শব্দবিন্যাসের কৌশল এবং ঝঙ্কৃত বাক্যবন্ধ সৃষ্টি তার আয়ত্তে ছিল না। এছাড়া ভাবোচ্ছ্বাসের অসংযম ও ধারাবাহিকতার অভাব তার ত্রয়ীকাব্যকে মহাকাব্যের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়নি।

কাহিনীর বিশাল বিস্তৃত পটভূমি থাকা সত্ত্বেও এসব দুর্বলতার কারণে সেই বোধের সৃষ্টি হয়নি যাকে প্রকৃত কাব্যোপাদান বলা যায়। মধুসূদনের বিশিষ্টতার কাছাকাছিও পেঁৗছাতে পারেননি নবীন চন্দ্র, বাকবৈদগ্ধের অভাবে। ধ্বনিতরঙ্গ সৃষ্টিতে তিনিও হেমচন্দ্রের মতো অসফল থেকে গেছেন। হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নবীন চন্দ্র সেন নাটকীয়তা ও ঘটনার ছন্দ বিক্ষোভের সৃষ্টির মাধ্যমে ঘটনাকে দৃশ্যমান করে তুলতেও ব্যর্থ হয়েছেন_ যেখানে মাইকেল মধুসূদন দত্ত ছিলেন সফল। মধুসূদন জীবনের গতিকে, প্রবাহের চাঞ্চল্যকে, বলিষ্ঠতাকে উপমা-রূপক উদপ্রেক্ষার মাধ্যমে বাঙ্ময় করে তুলেছেন। রাম এবং রাবণকে ঊনবিংশ শতাব্দীর পটভূমিতে দাঁড় করিয়ে তাদের যুদ্ধকে, সেই যুগ উৎকণ্ঠা-উদ্বেগের প্রতিচ্ছবি করে তুলতে পেরেছেন তার নিজের জীবনবোধ, যুগসচেতনা, নিজ অস্তিত্বের বর্তমানতার কারণে। মধুসূদন সেই বিরল মনীষার অধিকারী ছিলেন যে মনীষা থাকলে মানব অভিজ্ঞতার উপাদানগুলোকে শনাক্ত করা যায় এবং তা আত্মীকরণের মাধ্যমে সৃজনশীলতাকে জীবন সংলগ্ন করা যায়।

মেঘনাদ বধ কাব্য তাই জীবন-রসে পরিপূর্ণ হয়ে মহাকাব্যের লক্ষণকে পরিস্ফুটিত করেছে সফলভাবে। মানব অভিজ্ঞতা থেকে উদ্ভূত এবং উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেম সংকীর্ণ সম্প্রদায় বা রাজনৈতিক স্বার্থবুদ্ধির ঊধর্ে্ব উঠতে পারে। মধুসূদন ছাড়া আর কোনো মহাকাব্য রচনা প্রয়াসী সেই প্রকৃত দেশপ্রেমের অধিকারী ছিলেন না। তাই সামগ্রিকভাবে দেশের মানুষ, দেশের প্রকৃতি পরিবেশ এসব কিছুর সঙ্গে, মানুষের ভাগ্য ও তার বিপর্যয়ের সঙ্গে কেউই মধুসূদনের মতো একাত্ম হয়ে হয়ে উঠতে পারেননি। তাদের কাব্যপ্রয়াসও জীবন এবং জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে উঠতে পারেনি_ পারেনি জীবনের বিভিন্ন আয়োজনকে ধারণ করতে। মেঘনাদ বধ কাব্যের বলিষ্ঠতা ও জীবনের মুখর দ্বন্দ্বময়, চাঞ্চল্যের পাশাপাশি হেমচন্দ্র ও নবীন চন্দ্রের মহাকাব্য প্রয়াস শুধু নিষ্প্রভই নয়_ অসার ও জড়তাগ্রস্ত। যুগাদর্শ ও কাব্য ধারার পরিবর্তন সত্ত্বেও মধুসূদন আজও যুগস্রষ্টা ও বাংলা সাহিত্যে একমাত্র সফল মহাকবি হিসেবে স্বীকৃত। পক্ষান্তরে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ও নবীন চন্দ্র সেন উনিশ শতকের সাধারণ কবিদের শ্রেণীতে গণ্য হয়ে আছেন।

মধুসূদনের সময়কালের সামাজিক পরিবেশ, পরাধীন জাতির আত্মিক গ্গ্নানি, ভেদবুদ্ধির নীচতাজাত দ্বন্দ্ব-ক্ষোভ, মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও শক্তির সংশয়, ধর্ম-বর্ণাশ্রমের সংকীর্ণতার দন্তবিকাশী রূপ, ইয়াং বেঙ্গলের পথ নির্ণয়ের বিভ্রান্তিসহ যাবতীয় জীবন জটিলতার যে প্রেক্ষাপট তাকে উপলব্ধি করা এবং তার মাঝখানে নিজেকে আবিষ্কার করার ক্ষমতা সবার থাকে না। যার সে ক্ষমতা থাকে, তিনি হয়ে ওঠেন প্রথমত যুগের প্রতিনিধি, অতঃপর সম্মুখযাত্রার শক্তি ও প্রেরণা। ক্ষমতাহীনরা অতীত গৌরব হারানোর হাহাকার সর্বস্ব দীনতায় নিমজ্জিত হন। তাদের কাছে জাতি হয়ে ওঠে সম্প্রদায়_ এবং সেই সাম্প্রদায়িক ক্ষীণ দৃষ্টি বর্তমানকে আলোড়িত করতে পারে না। অতীতকে বর্তমানের প্রেক্ষাপটে প্রতিস্থাপিত করার যুগসচেতনতা না থাকায় তারা ঘটমানকালে নিজের উপস্থিতি এবং কালকের ঘটমান হিসেবে দেখতে ভয় পান। সৃজন অপেক্ষা বর্ণনাই হয়ে ওঠে তাদের কবিকৃতি। ক্ষমতা এবং অক্ষমতার এ দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েই উনিশ শতকের মহাকাব্য প্রয়াসের বিচার করতে হবে। তখনই মাইকেল মধুসূদন দত্তের সঙ্গে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, নবীন চন্দ্র সেন এবং পরবর্তী মহাকাব্য রচনা প্রয়াসীদের শক্তির দুস্তর ব্যবধান স্পষ্ট হয়ে উঠবে।


--------
সূত্র: ৩১ মার্চ ২০১০

No comments:

Post a Comment