কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় কোল-মুণ্ডা দেবী চণ্ডী বা চামুণ্ডা শব্দের ব্যবহার এবং এর ব্যুৎপত্তিগত তথ্য ও তাৎপর্য খোঁজা এই প্রবন্ধের মূল বিষয়। বাঙালির রক্তের আলোড়নে প্রথম আদিগান হয়ে উঠেছিল যে 'নিষাদ' জাতি, তা বোধ করি নেগ্রিটো রক্তের সঙ্গে কোল-মুণ্ডা-ভীল-সাঁওতাল প্রভৃতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিসত্তার আত্মস্বর। নজরুল সেই বাঙালি জাতিসত্তার আদিম এষণার হাত ধরে 'চামুণ্ডা' শব্দের ফাঁদে সাকার ও আকার দিয়ে আমাদের হাজার বছরের ভেসে যাওয়া নাভিচিহ্নকে ধরে দিতে চেয়েছেন। তাঁর গান, কবিতা, প্রবন্ধ, ভাষণের চৈতন্যে ও ভাব-বস্তুবিশ্বে চণ্ডী, শিব, কালিয়া, কালী এক অভেদাত্দা, যেন তা রুদ্ররূপে চামুণ্ডা শিবের প্রলয়-ঘূর্ণিনাচে আমাদের অন্তর আত্মায় ভস্মীভূত।
Friday, May 21, 2010
নজরুল : একবিংশ শতাব্দীর বাংলাদেশে - শান্তনু কায়সার
সকলেই জানেন, ১৯৪২ থেকে নজরুলের অসুস্থতার নানা লক্ষণ দেখা দিতে দিতে শেষ পর্যন্ত তিনি মূক হয়ে যান। তারপর থেকে ১৯৭৬-এ মৃত্যুর আগে পর্যন্ত তিনি যেভাবে বেঁচেছিলেন তাকে ঠিক বেঁচে-থাকা একজন কবি ও বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের বেঁচে থাকা বলে না। নজরুল কি কখনো নিজের ভবিষ্যত আন্দাজ করতে পেরেছিলেন? ১৩৪৩-এ ফরিদপুর জিলা মুসলিম ছাত্র-সম্মিলনে তিনি সভাপতির অভিভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘কতদিন মনে করেছি আমার জানাজা পড়া হয়ে গেছে। তাই যারা কোলাহল করে আমায় নিতে আসে মনে হয় তারা নিতে এসেছে আমায় গোরস্তানে – প্রাণের বুলবুলির স্থানে নয়। কতদিক থেকে কত আহ্বান আসে আজও। যত সাদর আহ্বান আসে তত নিজেকে ধিক্কার দিয়ে বলি – ওরে হতভাগা, তোর দাফনের আর দেরি কত? কতদিন আর ফাঁকি দিয়ে জয়ের মালা কুড়িয়ে বেড়াবি?’
সামপ্রতিক বিবেচনা ও নজরুল সংগীত - সাইম রানা
বাংলাদেশে নজরুল জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে তাঁর প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর যত ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়, তা একদিকে কবিকে মর্যাদা দান করে; অন্যদিকে সংস্কৃতিমান মানুষের চর্চার নতুন নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে_এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায়। কবির সৃষ্টিকর্মকে সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া বা তাদের আগ্রহী করে তুলতেও এই সব অনুষ্ঠান বেশ ভূমিকা রাখে।
উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির অবশ্য এ ধরনের আয়োজনের শেষ নেই, কথায় আছে না_বারো মাসে তেরো পার্বণ। ধর্মীয় উৎসব, ফসল ও ঋতু উৎসব, ব্যক্তিজীবনের জন্ম-মৃত্যু উৎসব, কৃত্যানুষ্ঠান_আরো কত কী! এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এবং পরবর্তীকালের চলার ছন্দ খুঁজে নেয়। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর কমতি হয়নি। বরং উদ্যোগের নানা পর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নজরুলকে আরো জানা-বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, সম্প্রতি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এতে নজরুলকে নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ নজরে পড়েছে, যেমন_ছয়-সাত শর মতো স্বরলিপি প্রণয়ন করা হয়েছে, গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে সিডিতে বাজারজাত করা হয়েছে, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গায়কি প্রশিক্ষণ, জাদুঘর নির্মাণ ও রাজধানীর মোড়ে মোড়ে স্মৃতিস্মারকসহ নানা উদ্যোগে নজরুল বেশ শক্ত-সমর্থ হয়ে জাতির সামনে অবস্থান নিয়েছেন।
উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির অবশ্য এ ধরনের আয়োজনের শেষ নেই, কথায় আছে না_বারো মাসে তেরো পার্বণ। ধর্মীয় উৎসব, ফসল ও ঋতু উৎসব, ব্যক্তিজীবনের জন্ম-মৃত্যু উৎসব, কৃত্যানুষ্ঠান_আরো কত কী! এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এবং পরবর্তীকালের চলার ছন্দ খুঁজে নেয়। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর কমতি হয়নি। বরং উদ্যোগের নানা পর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নজরুলকে আরো জানা-বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, সম্প্রতি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এতে নজরুলকে নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ নজরে পড়েছে, যেমন_ছয়-সাত শর মতো স্বরলিপি প্রণয়ন করা হয়েছে, গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে সিডিতে বাজারজাত করা হয়েছে, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গায়কি প্রশিক্ষণ, জাদুঘর নির্মাণ ও রাজধানীর মোড়ে মোড়ে স্মৃতিস্মারকসহ নানা উদ্যোগে নজরুল বেশ শক্ত-সমর্থ হয়ে জাতির সামনে অবস্থান নিয়েছেন।
Thursday, May 20, 2010
বাংলার নবজাগরণের পরম্পরা: নারী জাগৃতির পটভূমিকায় - আবদুল মান্নান সৈয়দ

রোজ ভোরবেলা ঘুম ভেঙে যায় আমার- সে যত রাতেই ঘুমোই না কেন? রাতে অনেকদিন ঘুম আসে না। তখন তোমার অনুমোদন নিয়ে ঘুমোই আর দুচোখ জুড়ে আসে। তুমি বোধহয় জাদু জানো। ভোরে ঘুম থেকে উঠে আধো-ঘুমে আধো জাগরণে শুয়ে থাকি অনেকক্ষণ। কত কি মনে আসে। ফেলে আসা জীবনের ছেঁড়া উড়ো স্মৃতির রেণুকণা, দু’একটি পাপড়ি। সে সব দিয়ে মালা গাঁথতে পারবে না। পাপড়ি দিয়ে কি মালা গাঁথা যায়? তার মধ্যেই আমি তো মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো কলম-পেষা মজুর। আজকের দিনে কি কাজ করব- তার একটা আবছা হিসেব থাকে। হিসেবের হেরফের কিন্তু প্রায়ই হয়। সেটা আবার আমার খারাপ লাগে না। ঘরের মুক্তি কিসে?- জানালায়। দরোজায়। আমার মুক্তি ঐ যে হলুদ রোদের ঝলক দেখছি দেয়ালে ঐ অধরা সোনায় সোনায়, ঐ কৃষ্ণচূড়ায় - জারুলে - সোনালুতে - বোগেনভিলিয়ায়, গাছের পাতার রঙ পরিবর্তনে, ঘাসের শ্যামলে, কোনো কোনো হৃদয়ের অন্দরমহলে। করিডোরে এসে রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে থাকি। ভোরবেলায় অপরূপ হাওয়া এসে গায়ে লাগে তার সমস্ত মাধুরী নিয়ে। স্নাত হয়ে যায় শরীরাত্মা। আর গভীর করে দেখি দু’একটি উড়ে আসা পাখি। আজ দেখছিলাম একটি শালিক পাখি- কালো বা খয়েরি রঙের মধ্যে যেন মোটা ব্রাশে টানে শাদা রেখা। কী যে অদ্ভুত সুন্দর! আজ যে জন্যে তোমাকে এই চিঠি লিখছি, তা নিষ্কারণে নয়। সেই প্রসঙ্গেই আসি সরাসরি।
Monday, May 17, 2010
“একজন তৃতীয় সারির কবি”: রবীন্দ্রকবিতার বোর্হেসকৃত মূল্যায়ন - রাজু আলাউদ্দিন
রবীন্দ্রনাথের অনুবাদক-ভাগ্য রীতিমত ঈর্ষণীয় বলা যেতে পারে। জীবদ্দশায় তাঁকে নিয়ে ইউরোপীয় ভাষায় গুরুত্বপূর্ণ লেখকরা লিখেছিলেন এবং তাঁর লেখা অনুবাদও করেছেন ইউরোপের বিভিন্ন ভাষার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখকরা।
—————————————————————–
উজ্জ্বয়িনীপুরের স্বপ্নময় আবেশ, শিপ্রানদীর শিহরণ এবং আরও নানান অনুষঙ্গ উধাও হওয়ার পর যে কংকালটি রয়েছে তা থেকে বিদেশী একজন পাঠক এই কবিতার মহিমা কতটুকু অনুমান করতে পারবেন সেটাই আমার প্রশ্ন।
—————————————————————-
তাদের অনেকেই পরবর্তীতে জয় করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। রুশ ভাষার বরিস পাস্তেরনাক অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ফরাসী ভাষায়
…….
বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, প্যারিস ১৯৩০; শেষ দেখা
…….
আঁদ্রে জীদের মতো লেখক। আরও একজন ফরাসী কবি ছিলেন যিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন, তিনি সাঁ ঝ পের্স। যদিও পরে তিনি এই দায়িত্ব অর্পণ করেন আঁদ্রে জীদকে। অন্য একটি ইউরোপীয় ভাষা অর্থাৎ স্প্যানিশে অনুবাদ করেছেন হুয়ান রামোন হিমেনেথের মতো কবি। তিনিও নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না হিমেনেথের সমগ্র রচনার এক তৃতীয়াংশ হলো রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ। স্প্যানিশ ভাষার আরেক লেখক এবং অনুবাদক রাফায়েল কানসিনোস আসসেন্সও অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মানব ধর্ম নামের প্রবন্ধের বইটি। রাফায়েল ছিলেন বোর্হেসের গুরু, যিনি জানতেন ১৪টির মতো ভাষা। এই সব ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করেছেন। কিন্তু যে তথ্যটি আমরা একেবারেই জানি না তাহলো এই যে স্প্যানিশ ভাষার আরেক লেখক যিনি আজ বিশ্বব্যাপী অসাধারণ এক কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ হোর্হে লুইস বোর্হেস, তিনিও রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুবাদ করেছিলেন।
—————————————————————–
উজ্জ্বয়িনীপুরের স্বপ্নময় আবেশ, শিপ্রানদীর শিহরণ এবং আরও নানান অনুষঙ্গ উধাও হওয়ার পর যে কংকালটি রয়েছে তা থেকে বিদেশী একজন পাঠক এই কবিতার মহিমা কতটুকু অনুমান করতে পারবেন সেটাই আমার প্রশ্ন।
—————————————————————-
তাদের অনেকেই পরবর্তীতে জয় করেছিলেন নোবেল পুরস্কার। রুশ ভাষার বরিস পাস্তেরনাক অনুবাদ করেছেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ফরাসী ভাষায়

বিক্তোরিয়া ওকাম্পোর সঙ্গে রবীন্দ্রনাথ, প্যারিস ১৯৩০; শেষ দেখা
…….
আঁদ্রে জীদের মতো লেখক। আরও একজন ফরাসী কবি ছিলেন যিনি রবীন্দ্রনাথের গীতাঞ্জলি অনুবাদের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন, তিনি সাঁ ঝ পের্স। যদিও পরে তিনি এই দায়িত্ব অর্পণ করেন আঁদ্রে জীদকে। অন্য একটি ইউরোপীয় ভাষা অর্থাৎ স্প্যানিশে অনুবাদ করেছেন হুয়ান রামোন হিমেনেথের মতো কবি। তিনিও নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত। আমরা হয়তো অনেকেই জানি না হিমেনেথের সমগ্র রচনার এক তৃতীয়াংশ হলো রবীন্দ্রনাথের অনুবাদ। স্প্যানিশ ভাষার আরেক লেখক এবং অনুবাদক রাফায়েল কানসিনোস আসসেন্সও অনুবাদ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের মানব ধর্ম নামের প্রবন্ধের বইটি। রাফায়েল ছিলেন বোর্হেসের গুরু, যিনি জানতেন ১৪টির মতো ভাষা। এই সব ভাষা থেকে তিনি অনুবাদ করেছেন। কিন্তু যে তথ্যটি আমরা একেবারেই জানি না তাহলো এই যে স্প্যানিশ ভাষার আরেক লেখক যিনি আজ বিশ্বব্যাপী অসাধারণ এক কথাসাহিত্যিক হিসেবে পরিচিত অর্থাৎ হোর্হে লুইস বোর্হেস, তিনিও রবীন্দ্রনাথের লেখা অনুবাদ করেছিলেন।
Thursday, May 6, 2010
রবীন্দ্রনাথের একটি চিঠি - সুধা সেন
রবীন্দ্রনাথ এ চিঠিঠি লিখেছিলেন অধ্যাপক সুধা সেনের (১৯১২—১৯৮৩) একটি চিঠি উত্তরে। এ নিয়ে সুধা সেনের একটি অপ্রকাশিত লেখা ছাপা হলো। চিঠিতে ভুলবশত ২৯/৩/২৯ লেখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে চিঠিটি ১৯৩৯ সালে লেখা। লেখাটি আমাদের দিয়েছেন সুধা সেনের কন্যা সুনন্দা কবীর।
তখন ব্রিটিশ আমল ও অখণ্ডিত দেশ। আসা-যাওয়া করতে পাসপোর্ট, ভিসা লাগত না। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা মাঝেমধ্যেই পূর্ববঙ্গে আসতেন। তাঁদের সমুজ্জ্বল সংস্কৃতির আলোয় পূর্ববঙ্গ ঝলমল করে উঠত। অবশ্যই পূর্ববঙ্গ কেবল গ্রহণই করত না—শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সংগীতে তারও অবদান কম ছিল না। বিশেষত কুমিল্লা তখন শিক্ষা-সংগীত জগতে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে ছিল। সুরের গুরু আলাউদ্দীন খান, ওস্তাদ খসরু মিঞা, শচীনদেব বর্মণ (যদিও তিনি ত্রিপুরার, কিন্তু কুমিল্লা তখন ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল এবং শচীনদেবের সংগীতচর্চার প্রধান কেন্দ্রই ছিল কুমিল্লা), সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ কুমিল্লারই কৃতী সন্তান। তখন দুই বাংলা এক অচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক বন্ধনে সংযুক্ত ছিল।
বাংলা ১৩৪৫ সনে (খ্রি. ১৯৩৯) কুমিল্লার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে সাহিত্য পরিষদ কুমিল্লা শাখার এক সম্মেলনের আয়োজন হয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সংগীত শাখার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং তাঁরা এই অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে সম্মতিও জানিয়েছেন। স্থান, তারিখ সমস্তই ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়নি শুধু উদ্বোধন সংগীত! ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়া চলবে না। তবে? ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা?’ না, তাও ঠিক উপযুক্ত হবে না।
তখন ব্রিটিশ আমল ও অখণ্ডিত দেশ। আসা-যাওয়া করতে পাসপোর্ট, ভিসা লাগত না। কাজেই পশ্চিমবঙ্গ থেকে শিল্পী, সাহিত্যিক, অভিনেতা মাঝেমধ্যেই পূর্ববঙ্গে আসতেন। তাঁদের সমুজ্জ্বল সংস্কৃতির আলোয় পূর্ববঙ্গ ঝলমল করে উঠত। অবশ্যই পূর্ববঙ্গ কেবল গ্রহণই করত না—শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, সংগীতে তারও অবদান কম ছিল না। বিশেষত কুমিল্লা তখন শিক্ষা-সংগীত জগতে এক বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে ছিল। সুরের গুরু আলাউদ্দীন খান, ওস্তাদ খসরু মিঞা, শচীনদেব বর্মণ (যদিও তিনি ত্রিপুরার, কিন্তু কুমিল্লা তখন ত্রিপুরার অন্তর্গত ছিল এবং শচীনদেবের সংগীতচর্চার প্রধান কেন্দ্রই ছিল কুমিল্লা), সুরসাগর হিমাংশু দত্ত, গীতিকার অজয় ভট্টাচার্য, সুবোধ পুরকায়স্থ কুমিল্লারই কৃতী সন্তান। তখন দুই বাংলা এক অচ্ছেদ্য সাংস্কৃতিক বন্ধনে সংযুক্ত ছিল।
বাংলা ১৩৪৫ সনে (খ্রি. ১৯৩৯) কুমিল্লার বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীদের উদ্যোগে সাহিত্য পরিষদ কুমিল্লা শাখার এক সম্মেলনের আয়োজন হয়। সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন, শিল্প, সংগীত শাখার বিশিষ্ট ব্যক্তিরা তাতে আমন্ত্রিত হয়েছেন এবং তাঁরা এই অধিবেশনে যোগদান করবেন বলে সম্মতিও জানিয়েছেন। স্থান, তারিখ সমস্তই ঠিক হয়েছে, ঠিক হয়নি শুধু উদ্বোধন সংগীত! ‘বন্দেমাতরম্’ গাওয়া চলবে না। তবে? ‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা?’ না, তাও ঠিক উপযুক্ত হবে না।
রবীন্দ্রনাথের ধর্মীয় পরিচয় - গোলাম মুরশিদ
হিন্দু ছিলেন রবীন্দ্রনাথ—এ কথা সবাই জানেন। হিন্দু, মুসলমান—সবাই। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য-সংগীতের সঙ্গে কোনো পরিচয় থাক, না-ই থাক অথবা যত কমই পরিচয় থাক—মুসলমানরা এটা এত ভালো করে জানেন যে নোবেল পুরস্কার পেয়ে সারা পৃথিবীতে বাঙালিদের গৌরব বৃদ্ধি করলেও, দীর্ঘকাল তাঁকে নিজেদের কবি বলেই স্বীকার করতে চাননি। এ নিয়ে তর্ক-কুতর্ক সবই হয়েছে সাম্প্রতিক কালেও। কদিন আগে ২ মে শেক্সিপয়ারের জন্ম হয়েছিল দক্ষিণ-পশ্চিম ইংল্যান্ডের যে বাড়িতে, সেই বাড়ি দেখে এলাম। তাঁর বাগানে অন্য আর একজন মাত্র বিখ্যাত মানুষের একটি আবক্ষমূর্তি বসানো আছে। সেটি আমাদের বাঙালি কবি রবীন্দ্রনাথের। ছয় হাজার মাইল দূরের জোড়াসাঁকো থেকে সুদূর স্ট্র্যার্টফোর্ডে চলে এসেছেন। দেখে গর্বে বুক ফুলে উঠল। কিন্তু একজন সহযাত্রী, যিনি ৪২ বছর বিলেতে আছেন বলে গর্ব করেন, তিনি বললেন, ‘সামনেরবার এসে ওই মূর্তিটা সরিয়ে ওখানে নজরুলের একটি মূর্তি বসিয়ে যাব।’ কাজেই, রবীন্দ্রনাথ অমুসলমান ছিলেন—বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশ এখনো এটা ভুলতে পারেননি।
Subscribe to:
Posts (Atom)