Friday, May 27, 2011

বিদ্রোহী -- রংগন চক্রবর্তী

চুরুলিয়ার দুখু মিঞা
৮৯৯ সালের ২৪ মে বর্ধমানের অজয় নদীর ধারে চুরুলিয়া গ্রামে জন্মেছিল বাচ্চাটা। বংশ ছিল কাজীদের। তাঁরা নাকি মোগল সম্রাট দ্বিতীয় শাহ আলমের আমলে বিহার থেকে চলে এসে বসতি গেড়েছিলেন এই গ্রামে। তখন কিছু নিষ্কর জমি থাকলেও দুখুর জন্ম হতে হতে সব চলে গিয়ে থেকে গিয়েছিল অশেষ দারিদ্র। নটি ছেলেমেয়ে আর দুই স্ত্রী নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন আব্বাজান কাজী ফকির আহমেদ। দ্বিতীয় স্ত্রী জাভেদা খাতুনের গর্ভে  ষষ্ঠ সন্তানের ভাল নাম নজরুল ইসলাম হলেও, ডাক নাম দুখু মিঞাটাই বেশি জুতসই হয়েছিল।


কোন দেশের ভগ্নাবশেষ কোন দিদিমার কাহিনীর শেষ?
চুরুলিয়া গাঁয়ের আশেপাশে ছিল অনেক ভগ্নাবশেষ। রাজা নরোত্তম সিংহের গড়, পীরপুকুর আর তার পাড়ে পীরের মাজার আর দরগা। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে এই সব ইটপাথরের ইতিহাসের মধ্যে ঘুরে বেড়াত ছোট্ট ছেলেটা। তার মন ধরে রাখত সব আলোছায়া। আজ, আর ফেলে আসা কালের গল্প। তাই নিয়ে পরে ভগ্নস্তূপ নামে কবিতাও লিখবে সে। আব্বু মারা যাবেন দুখুর নবছর বয়সে। গ্রামের মক্তব থেকে পাশ দিয়ে দশ বছর বয়সেই গ্রামের মসজিদে খুদে মোল্লার কাজও নিতে হবে ওকে। ছোটবেলার ওই ধর্ম শিক্ষা কিন্তু নজরুলের মনে আরবি, ফার্সি, উর্দু ভাষার প্রতি ভালবাসা আর দক্ষতা তৈরি করে দিয়েছিল। যার জন্যে ওঁর লেখায় এমন কিছু স্বাদ আমরা পাই, যা বাংলা সাহিত্যে একেবারে অনন্য বললে ভুল হয় না। সেই উত্তরাধিকার বাংলা সাহিত্য হারিয়ে ফেলেছে।

দেখে ইহা ভদ্রলোকে রাগল ছড়াদার ও দোহাররা সব ভাগল।
বাড়ি থেকে পালানোর রোগটা ছেলেটার থেকে যাবে প্রায় চিরকাল। সেই ছোট্ট বেলায় গ্রামে মোল্লাগিরি করা মোটেও ভাল লাগবে না তার। জীবনে রং সুর তাল খুঁজতে সে পালিয়ে চলে যাবে লেটো-র দলে। এগারো-বারো বছরেই লেটো গানের দলে কবিয়াল হিসেবে হাত পাকাবে, নামও ছড়াবে। এই সময় থেকেই তার ইসলামীয় শিক্ষায় এসে মিশবে হিন্দু দেবদেবীর ছবি। এক দিন যে সে বলবে, হিন্দু না ওরা মুসলিম ওই জিজ্ঞাসে কোন জন? কাণ্ডারী বলো মরিছে মানুষ সন্তান মোর মার, সেই বোধটা এই সময় থেকেই একেবারে মজ্জার মধ্যে গেড়ে বসে যাবে তার। সাম্প্রদায়িকতা দেখলেই মার মার করে ছুটে যাবে।

আমি চাইনে হতে ভ্যাবাগঙ্গারাম, ও দাদা শ্যাম

লেটো দল ছেড়ে ইস্কুলে ভর্তি হবে দুখু। কিন্তু খাবে কী? স্কুল ছেড়ে তাই আবার কবির দলে কবিয়াল। চলতে থাকবে ঘাট থেকে ঘাটে নৌকো বাঁধার জীবন, কখনও চায়ের দোকানে কাজ, কখনও কারও বাড়িতে। রাতে শোয়ার জায়গা নেই, নজরে পড়ল পুলিশের এক সাব ইন্সপেক্টরের। তিনি ওকে পাঠিয়ে দিলেন ময়মনসিংহে, তাঁর গাঁয়ের বাড়িতে। সেখানে ইস্কুলে সবার নজর কাড়ল দুখু আরে কী ভাল রবি ঠাকুরের কবিতা আবৃত্তি করে ছেলেটা! পরীক্ষায় ভাল ফল করলেও স্থানীয় লোক জনের সঙ্গে মোটেও বনিবনা হল না তার। ব্যাক টু বর্ধমান, ভর্তি হল সিয়ারসোল স্কুলে। এই প্রথম তিন বছর এক স্কুলে পড়বে দুখু। ভাল ছাত্র হিসেবে মাইনেতে ছাড় পাবে, জমিদারের বৃত্তিও পাবে। তার লেখায় একটা শহুরে ছাপ আসবে। যে দুটো বৈশিষ্ট্য তার বাকি জীবনের লেখায় ফুটে উঠবে, সেই গুণ দুটোও আমরা এখন থেকে দেখব: করুণ রস আর বিদ্রোহ। দুখু মিঞার জীবন-তারে এই দুটো সুরই যেন বেঁধে দিয়েছেন এক অদৃশ্য মহাশক্তি।

কেউ ভোলে না কেউ ভোলে
সিয়ারসোলে নজরুলের বন্ধু হয়ে উঠবেন শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়। যিনি নিজেও হবেন প্রথিতযশা সাহিত্যিক। ইস্কুলে নজরুল শিখবেন অনেক কিছু। ছোটবেলায় পড়া আরবি, ফার্সি আরও গভীর ভাবে অধ্যয়ন করতে পারবেন হাফিজ নুরুন নবি সাহেবের কাছে। পাশাপাশি শিখবেন সংস্কৃত। শিক্ষক সতীশচন্দ্র কাঞ্জিলাল এই দামাল ছাত্রটিকে বাড়ি নিয়ে গিয়ে শেখাবেন ভারতীয় রাগ সঙ্গীত। পাশাপাশি শুরু হবে আর এক ভিত স্থাপনের কাজ। যুগান্তর দলের কর্মী নিবারণ ঘটক ছিলেন স্কুলের শিক্ষক। তিনি এই ভয়হীন ছাত্রটির কানে স্বদেশপ্রেমের মন্ত্র দেবেন। দুখু এই মন্ত্র ভুলবে না কোনও দিন।

জাগো আজ দণ্ড হাতে চণ্ড বঙ্গবাসী
বাঙালির এক বড় দুঃখ ছিল: অ-সামরিক জাত বলে ইংরেজরা তাদের সৈন্যদলে নিত না। বাংলার জাতীয়তাবাদের একটা বড় দিকই ছিল শরীরচর্চা। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সৈন্যদলে যোগদানের জন্য বাঙালি উঠেপড়ে লাগল। ১৯১৬ সালে ইংরেজরা প্রথম বাঙালিদের সৈন্য দলে নিল। ১৯১৭ সালে ফর্টিনাইন্‌থ বেঙ্গলিজ বলে ৭০০০ সেনার রেজিমেন্ট চালু হল। সৈন্যদলে যোগ দেওয়ার নেশা যে চিরদিনের ছটফটে নজরুলকে টানবে তাতে আর আশ্চর্য কী। বন্ধু শৈলকেও নিয়ে গেলেন টানতে টানতে। নজরুল ঢুকে গেলেন, স্বাস্থ্যের কারণে শৈলজা বাতিল হয়ে গেলেন। পরে জানা গিয়েছিল, তাঁর পরিবার কিছু কলকাঠি নেড়েছিল।
নজরুল তো গেলেন সেনা বাহিনীতে। কিন্তু ট্রেনিং নেওয়াই সার হল, সত্যিকারের যুদ্ধে যাওয়া হল না। কিন্তু সেনা ছাউনিতে বসেই নজরুল পেলেন সোভিয়েত বিপ্লবের খবর। সেনাবাহিনীতে বসে তিনি ব্রিটিশদের ভারতবিদ্বেষ, বর্ণবাদের নানান পরিচয় পেলেন, যা তাঁর স্বাধীনতা-স্বপ্নকে আরও জোরদার করে তুলল। এ ছাড়া কোয়াটার মাস্টারের ডিউটির ফাঁকে ফাঁকে তিনি পড়ে ফেললেন ইরানের কবিদের কবিতা। হাফিজের কবিতা আন্দোলিত করল তাঁর মন। নজরুল যে বার বার গোঁড়ামির বাইরে এক নতুন খোলামেলা সহিষ্ণু ইসলামের কথা বলে যাবেন, সেই বোধের কিছুটা অবশ্যই এসেছিল সুফি দর্শন থেকে, ফতোয়ার বাইরে লেখা কাব্যের এক অপূর্ব রঙিন উজ্জ্বল ইতিহাস থেকে।

জাতের নামে বজ্জাতি সব
১৯২০ সালে যুদ্ধ থেকে দেশে ফিরে এলেন নজরুল। শুরু হল এক বন্ধুত্ব, যা তাঁর জীবনে গভীর প্রভাব ফেলবে। বন্ধুটির নাম মুজফ্‌ফর আহমেদ, ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি তখন বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য সমিতির সঙ্গে যুক্ত। দুখু তো সেই ভোলাভালা, তার তো কোনও ঠিকানা নেই, মুজফ্‌ফর তাই বললেন, তুমি আমাদের সমিতির অফিসে এসেই থাকো। থাকতে হতই। কলকাতায় এসে শৈলজানন্দের মেসে উঠেছিলেন নজরুল। সেই মেসের কাজের লোকটি যখন জানতে পারল এই নতুন অতিথিটি হিঁদু নয়, তখন সে তার বাসন ছুঁতে অস্বীকার করল। শৈল নিজেই ধুয়ে ম্যানেজ দিচ্ছিলেন, কিন্তু নজরুল জেনে ফেললেন, তার পর তার পক্ষে ওখানে আর থাকা সম্ভব হল না।

গাহি সাম্যের গান
নির্মম বিশ্লেষণ সম্ভবত বলবে কোনও একটা মতবাদের বা দর্শনের অনুসারী হতে হলে চিন্তার বা আচরণের যে ধারাবাহিকতা লাগে, নজরুলের মধ্যে ছিল না। নজরুলের জীবন অস্থিরতায় ভরা। কিন্তু এক জন কবির মধ্যে অজর-অমর-অক্ষয় হয়ে ওঠার গুণ যদি আমরা না খুঁজি, তা হলে আমরা দেখব, তাঁর পথ চলায় অনেক আঁকাবাঁকা দিকে এগোনো থাকলেও কোনও লক্ষ্য নেই, তা নয়। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে নজরুল যে ভাবে প্রতিবাদ করেছেন, তার জন্যে যে ভাবে জেলে গিয়েছেন, অনশন করেছেন, দারিদ্রকে মেনে নিয়ে বার বার প্রতিরোধে এগিয়ে গিয়েছেন, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তার কোনও তুলনা আছে বলে মনে হয় না। নবযুগ থেকে ধূমকেতু, লাঙল থেকে সাম্যবাদী, একটা ছটফটে টগবগে মানুষের গল্প। চার পাশের অন্যায় তাকে খেপিয়ে তোলে, সে তার রক্তে মেশা সুর আর গান, তার ফুটন্ত রাগ আর জ্বলন্ত বোধকে ঢেলে দেয়। নিজের পিঠ বাঁচানোর কোনও গল্প তার জানা নেই।
নজরুলের বিশ্বাসে আবার অদ্ভুত ছেলেমানুষির দিকও কিছু ছিল। ধূমকেতু দিনগুলোতে তাঁর মাথায় ঘুরছিল ইসলাম আর বলশেভিজমের মধ্যে যোগাযোগে গভীর বিশ্বাস। এক দিকে তিনি আনোয়ার পাশা আর সোভিয়েত রাশিয়ার মধ্যে সহযোগিতার ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করেছিলেন, অন্য দিকে তিনি আবার রুশ নেতা জোসেফ স্তালিনকে মুহম্মদ সালাতিন বলে বর্ণনা করেছিলেন! ইসলাম আর বলশেভিক বিশ্বাসের মিলনকে তিনি রাম আর সুগ্রীবের সখ্য হিসেবে দেখেছিলেন। প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, নজরুলের বিশ্বাসে অতিরঞ্জন ও ভ্রান্তি অবশ্যই ছিল, কিন্তু বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে সোভিয়েত দেশগুলিতে, এশিয়া ও আফ্রিকার নানান প্রান্তে এবং আমাদের দেশেও ইসলাম আর সাম্যবাদী মতের মিল নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছিল। তাই নজরুলের মতটাকে কেবল ছেলেমানুষি বলে দেখাটাও বড় ধরনের ভুল হবে।

মরণ হরণ নিখিল শরণ জয় শ্রীচরণ ভরসা!
নজরুল আবার এর মধ্যে আর এক কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলেছিলেন! বিয়ে হয়ে যাচ্ছিল তাঁর। ঝামেলার জন্যে তিনি নিজে এক বারেই দায়ী ছিলেন না, তা নয়। কুমিল্লার কাছে দৌলতপুরে বেড়াতে গিয়ে এক স্বল্পশিক্ষিত সুন্দরীকে ভাল লাগল তাঁর। মেয়েটিও তাঁকে বিয়ে করতে রাজি। এমন দামাল সুন্দর কবিকে বিয়ে করতে রাজি না হওয়ার কারণ তো নেই, বিশেষ করে যদি মেয়েটির বাপের বাড়ি এই খ্যাপাটে জামাইয়ের ভরণপোষণের দায় নিয়ে তাকে ঘরজামাই করে রাখতে চায়। এই কথাটাই অবশ্য শেষ পর্যন্ত কাল হল। বিয়ের আসরে কাজি এসে যাওয়ার পরে কবি টের পেলেন, আরে এই বিয়ে তো করা যাবে না। সারা জীবন এই গাঁয়ে ঘরজামাই থাকবে কে? চটি খুলে ছুট। মানে যাকে বলে থাকিতে চরণ মরণে কী ভয় নিমেষে যোজন ফরসা। সত্যিই তাই। কাদার মধ্যে ১৫ কিলোমিটার ছুটে কুমিল্লায় এসে শান্তি।
কুমিল্লাতেই শেষে মনের মানুষ মিলবে কবির। সেই ১৯২১ সালে অবশ্য কবির বয়স ২২ আর আমাদের প্রমীলা সেনগুপ্তের বয়স ১৩। বিয়েটা হবে পরে। তবে মন দেওয়া-নেওয়াটা তখনই হয়ে যাবে। এই সেনগুপ্ত পরিবারেই ঘর-ছুট নজরুল যেন খুঁজে পাবেন পরিবার আর মা। পরে তিনি যখন কারাগারে অনশনে মরতে বসবেন, তখন ৩৯তম দিনে প্রমীলার মাসি বিরজাসুন্দরী দেবীই পারবেন তার মুখে খাবার তুলে দিতে। আবার ভাগ্যের কী পরিহাস। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল যখন নজরুল আর প্রমীলা বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হবেন, এই বিরজাসুন্দরীর আশীর্বাদ তাঁরা পাবেন না। নজরুলের নিজের পরিবারের কেউ উপস্থিত থাকবেন না এই অনুষ্ঠানে। ইসলামীয় মতে বিয়ে হবে। যদিও প্রমীলা ধর্ম বদলাবেন না। বিয়ের পর এই দম্পতি নতুন ঘর বাঁধবেন হুগলিতে। একটি সন্তান জন্ম নেবে। তার নাম রাখা হবে কৃষ্ণ মহম্মদ। জীবনের সব ক্ষেত্রেই সাম্প্রদায়িকতাকে পেরিয়ে যেতে হবে যে। কিন্তু নজরুল আর প্রমীলার জীবনে তো বেশি দিন সুখ সইবে না। জন্মের কয়েক মাস পরেই শিশুটি মারা যাবে।

বলো বীর, বলো উন্নত মম শির
করুণ রস কবির জীবনে ফিরে আসবে বার বার। কিন্তু চোখের জলকে আগুনে পরিণত করবেন বলেই তো তিনি বিদ্রোহী কবি। চাল নেই, চুলো নেই, খাবার নেই, ঘর নেই, কিন্তু কলম তো আছে। ১৯২১ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে তাই তিনি লিখতে পেরেছিলেন বিদ্রোহী কবিতা। ১৯২১ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে ৩ বাই ৪-এর সি তালতলা লেনে বসে নজরুল লিখলেন এই কবিতা। পৃথিবীর যে কোনও ভাষায় বিদ্রোহী চিরকালের সেরা সৃষ্টির মধ্যে পরিগণিত হওয়ার যোগ্য। এই ঠিকানা দেখতে টিকিট কেটে ভিড় জমানো উচিত। আমাদের গিয়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে কান পেতে শোনা উচিত, চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম, খেতে না পাওয়া, স্কুলে যেতে না পাওয়া একটা বাচ্চা ২২ বছরে এসে লিখছে, আমি উত্থান, আমি পতন, আমি অচেতন চিতে চেতন, আমি বিশ্ব তোরণে বৈজয়ন্তী, মানব বিজয় কেতন। চায়ের দোকানে কাজ করে রাতে রাস্তায় শুয়ে থাকা সেই দুখু মিঞা বলছে, ধরি বাসুকির ফণা জাপটি, ধরি স্বর্গীয় দূত জিব্রাইলের আগুনের পাখা সাপটি। আমি দেব শিশু আমি চঞ্চল, আমি ধৃষ্ট, আমি দাঁত দিয়া ছিঁড়ি বিশ্বমায়ের অঞ্চল। কী রকম যেন মনে হয়, কোথাও একটা এই কবিতাটা টাঙিয়ে দিয়ে মধুসূদন দত্তের ভাষায় বলা যায়, দাঁড়াও পথিক বর, জন্ম যদি তব বঙ্গে তিষ্ঠ ক্ষণকাল।
মনে রাখা দরকার, কোন বাংলায় দাঁড়িয়ে এই কবি এত অনায়াসে ছুটে যাচ্ছেন বাসুকি থেকে জিব্রাইলে। যে বাংলায় সাম্প্রদায়িক বোধ বিপন্ন করছে আমাদের স্বাধীনতা বাসনাকে, যার ফলে আমরা পাব ভাঙা স্বাধীনতা। টুকরো টুকরো হয়ে যাবে জীবন, দেশ, ইতিহাস। নজরুলের এই যে আজীবনের বিদ্রোহ এই বিভেদের বিরুদ্ধে, তাঁর যে এই অকল্পনীয় জোরদার চিৎকার, তাকে কি আমরা চিনতে পেরেছিলাম? মনে তো হয় না। তাই বোধ হয় বড় অভিমানে নজরুল নিজেকে যুগের না হই হুজুগের কবি বটি তো রে দাদা বলে কৈফিয়ৎ দেবেন। বাংলা কাব্য আর গান কোথাও গিয়ে ব্রাহ্মণ্য আর ব্রাহ্ম ধর্মের পরিশীলিত ভাবের ন্যাকা পাঁকে ডুবে মরবে। হারিয়ে যাবে রক্ত, মাংস, রাগ, ভালবাসা। হারিয়ে যাবে সাধারণের প্রাণের কথা।

আজি পরীক্ষা জাতিরে অথবা জাতেরে করিবে ত্রাণ
১৯২৬ সালের এপ্রিলের গোড়ায় কলকাতায় হিন্দু মুসলমান দাঙ্গা বেধে গেল। দুঃখের বিষয় দাঙ্গা উস্কে দিয়েছিল রাজনীতিই। দুদলের নেতা আর তাঁদের মুখপত্রে চলল পারস্পরিক কাদা ছোড়াছুড়ি। উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম ছিলেন এই সময়ের পেজেন্টস অ্যাণ্ড ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা মুজফ্‌ফর আহমেদ, সৌমেন্দ্রনাথ ঠাকুর, হেমন্ত সরকার এবং অবশ্যই নজরুল ইসলাম। দাঙ্গা বাধানোর পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা দেখে একেবারেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লেন নজরুল। কিন্তু প্রতিবাদ না করে রণে ভঙ্গ দেওয়ার পাত্র তো তিনি নন। প্রভিনশিয়াল কংগ্রেস কনফারেন্স উপলক্ষে রচিত হল কাণ্ডারী হুঁশিয়ার। গানটি শুনে মুগ্ধ হলেন স্বয়ং সুভাষচন্দ্র। যুবকদের কনফারেন্সের জন্য নজরুল লিখলেন, ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল, নিম্নে উতলা ধরণীতল, অরুণ প্রাতের তরুণ দল চল রে চল রে চল।
এরও কিছু দিন পরে বন্ধু মুজফ্‌ফর আহমেদ ও গণবাণীর কমরেড বন্ধুদের অনুরোধে নজরুল অনুবাদ করবেন ইন্টারন্যাশনাল, জাগো জাগো সর্বহারা, অনশনবন্দি ক্রীতদাস, শ্রমিক দিয়াছে আজ সাড়া, উঠিয়াছে মুক্তির আশ্বাস।

বাগিচায় বুলবুলি তুই
১৯৩৪ সালে ইন্টারন্যাশনাল অনুবাদ করলেও আসলে ১৯৩০ দশকের গোড়া থেকেই নজরুলের জীবনে একটা নতুন যুগ আসবে, সেটা হল গজলের যুগ। প্রথম গজলটি কিন্তু তিনি হঠাৎই লেখেন। কলকাতার পার্শি থিয়েটারের মালিকের অনুরোধে নজরুল ফার্সি ভাষায় গজল লেখেন ও অনুষ্ঠানে গান। কিন্তু বাংলায় গজল লেখার উৎসাহ তাঁর এল কিছু দিন পরে। দ্বিতীয় পুত্র জন্ম নিল। নানান আঘাতে জর্জরিত নজরুল প্রমীলার সংসারে এল আনন্দের বান। খুশিতে শিশুর নাম রাখা হল বুলবুল। আর নজরুলও যেন বুলবুল হয়ে উঠলেন।
কিছু দিনের জন্য যেন সত্যিই বসন্ত এল। নজরুলের গান গাইলেন দিলীপকুমার রায়, গাইলেন রাণু (প্রতিভা) সোম এই প্রতিভাই পরবর্তী দিনে বুদ্ধদেব বসুর স্ত্রী হবেন। গ্রামোফোন কোম্পানিতে কনট্রাক্ট পেলেন কবি। টাকাও পেলেন কিছু। গ্রামোফোনের ডিস্কে তখন গীতিকার আর সুরকারের নাম ছাপা হত না। এর আগেই কেউ এক জন তাঁর গান রেকর্ডও করে ফেলেছিলেন। গীতিকার সুরকারের নাম কেউ জানত না। এ বার এতই জনপ্রিয় হল নজরুলের গান যে, কোম্পানি তাঁর বকেয়া টাকাও মিটিয়ে দিলেন! চিরদিনের গরিব দুখু মিঞার জীবনে এল স্বাচ্ছন্দ্য। কে জানত ছেলে বুলবুলের মতো এই সুদিনও হবে ক্ষণিকের অতিথি।

ফুলের জলসায় নীরব কেন কবি
১৯৩৯ সালে প্রমীলাকে আক্রমণ করল পক্ষাঘাত। নজরুল হয়ে উঠলেন ঘোর বিশ্বাসী। হিন্দু, মুসলমান নানা মতের নানান জলপড়া, নানান টোটকা কিছু বাদ রাখলেন না। প্রমীলাকে ভাল করে তুলতেই হবে। হল না। তৃতীয় পুত্র সব্যসাচীও তখন ছোট। প্রমীলা চিরজীবনের মতো শয্যাশায়ী হলে গেলেন। এর কিছু দিন পরে, ১৯৪২ সালে নীরব হয়ে গেলেন বিদ্রোহী কবি নজরুল ইসলাম। হারিয়ে গেল শব্দ, স্মৃতি, চার পাশকে চিনতে পারার শক্তি। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ ৩৪টি বছর এই ভাবেই বেঁচে থাকলেন তিনি, তার পর চলে গেলেন।

দে গরুর গা ধুইয়ে
নজরুলকে কি আমরা ঠিক ভাবে বুঝেছি? দাম দিয়েছি? তাঁর উত্তরাধিকার হারিয়ে যাওয়া যে বাংলা সাহিত্য আর মননের ক্ষেত্রে কত বড় ক্ষতি তার মূল্যায়ন করেছি কখনও? উত্তর হল, না। রবীন্দ্রনাথকে ঘিরে আমরা এক উন্নাসিক সংকীর্ণ রাবীন্দ্রিকতা তৈরি করেছি। আমাদের চেনা বামপন্থায় রাজ করেছে উচ্চ বর্গীয় জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতিক ফরমান আর ব্রাহ্মণ্যবাদের সাংস্কৃতিক কৌলিন্যবোধ। কোথায় হারিয়ে গেছে শেখ গুমানি, সনাতন দাস, রমেশ শীল, মহানন্দ, নিবারণ পণ্ডিত এবং গুরুদাসের গান। কল্কে পাননি হেমাঙ্গ বিশ্বাস। পাশাপাশি হিন্দু ঔদ্ধত্যের ভাবনা নিয়ে আমরা তৎভব আর তৎসমের পুজো করেছি। আজ উচ্চ বর্গীয় জাতীয়তাবাদী সংস্কৃতি সালাম ঠুকছে আজকের গ্লোবাল সাম্রাজ্যের ভাষা ইংরেজি আর আমেরিকানিজমকে। বাই-লিঙ্গুয়াল ইন্টেলিজেন্টসিয়া হারিয়েছে তার মাতৃভাষা। আমাদের সাম্প্রদায়িকতা ধীরে ধীরে আমাদের আরবি-ফারসি-উর্দু থেকে সরিয়ে নিয়েছে। যে বিশাল জন গোষ্ঠী, মন গোষ্ঠী থেকে উঠে এসেছিল সুফি দর্শন আর সঙ্গীত, যে ঐতিহ্যের উত্তরাধিকার নিয়ে এসেছিলেন নজরুল ইসলাম, তাকে আমরা ম্লেচ্ছ বলে ব্রাত্য করেছি। ফল যা হওয়ার তাই হয়েছে, বহু জোরদার সমৃদ্ধ উচ্চারণ আমরা হারিয়েছি। আমাদের ভাষা হয়ে উঠেছে স্বল্প সংখ্যক লোকের ভাবালু, নীরক্ত, পানসে, প্যানপ্যানানি। আমাদের সংস্কৃতি তাই মানুষের সঙ্গে যোগ হারিয়েছে। আর এই ছুৎমার্গিতার সুযোগ নিয়ে বাজার লৌকিককে কেবল হাল্কা, কেবল পলকা, কেবল ছ্যাবলামোর আড্ডা করে তোলার উৎসবে নেমেছে।
নজরুল থাকলে এই এত বড় জায়গাটা এত সহজে হাতছাড়া হত না। কারণ, তিনি বলে উঠতেন, দে গরুর গা ধুইয়ে।
তিনিই পারতেন।
 ✒✒✒
ঋণ: দ্য ডিসেন্ট অব নজরুল ইসলাম। প্রীতিকুমার মিত্র,অক্সফোর্ড












 সূত্র: আনন্দবাজার পত্রিকা: রোববারের প্রবন্ধ: ২৯ মে ২০১১

No comments:

Post a Comment