Sunday, March 13, 2011

গাদ্দাফিনামা - গৌতম চক্রবর্তী

গাদ্দাফিনামা
একটি মানুষ যখন একটি দেশ হয়ে উঠতে চান, তখন তৈরি হয় ইতিহাসের এক বিচিত্রতম
অধ্যায়। তেমনই এক আশ্চর্য একনায়কের জীবন কিস্‌সা বলছেন গৌতম চক্রবর্তী
ই আসছেন তিনি! সাম্রাজ্যবাদীদের চক্রান্ত তছনছ করে, দেশে ফিরে আসছেন জাতীয় বীর আবদেল বাসেত আল মাগরাহি। এত রাতেও বিমানবন্দরের বাইরে দাঁড়ানো ভিড়টা গর্জন করে উঠল। বিমান ততক্ষণে থামার দৌড় শুরু করেছে।
২০ অগাস্ট,২০০৯। ত্রিপোলির বিমানঘাঁটিতে প্রাইভেট জেট থেকে নেমে এলেন আল মাগরাহি। তাঁর সঙ্গে সাইফ আল ইসলাম আল গাদ্দাফি। লিবিয়ার একচ্ছত্র নেতা মুয়াম্মর গাদ্দাফির ছেলে সাইফ ডিউক অভ ওয়েলিংটনের ব্যক্তিগত বন্ধু, লণ্ডন স্কুল অভ ইকনমিক্স থেকে ডক্টরেট করেছেন। স্কটল্যাণ্ড থেকে জাতীয় বীরকে দেশে ফিরিয়ে আনলেন তিনি। সেখানেই বন্দি ছিলেন আল মাগরাহি! সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসছেন সাইফ আর আল মাগরাহি। এবং তার পরই চমক! জাতীয় বীরের জন্য অপেক্ষা করছেন মুয়াম্মার গাদ্দাফি স্বয়ং! আল মাগরাহিকে জড়িয়ে ধরলেন তিনি। কে না জানে, বিপ্লব চিরস্থায়ী! ছোট্ট দেশ লিবিয়ায় প্রতিটি সেতু থেকে রাস্তাঘাটের হোর্ডিং, ট্রাকের পিছনে সর্বত্র মুয়াম্মার গাদ্দাফির ছবি। নিচে তাঁর বাণী: বিপ্লব চিরস্থায়ী।
 
আর কয়েক দিন পরেই, ১ সেপ্টেম্বর সেই চিরবিপ্লব-এর ৪০ বছর পূর্তি! ১৯৬৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসেই মুয়াম্মার গাদ্দাফি ও সেনাবাহিনীর বিদ্রোহে সরে যেতে হয়েছিল লিবিয়ার রাজা প্রথম ইদ্রিসকে। অসুস্থ রাজা তখন তুরস্কে, সেই সুযোগে ২৭ বছরের গাদ্দাফির ক্ষমতা দখল। দুনিয়ায় হিটলার, স্তালিন, মাও জে দং... কেউই টানা চার দশক এ ভাবে ক্ষমতায় থেকে যেতে পারেননি, একই সঙ্গে মানুষের নেতা এবং ভাই হয়ে উঠতে পারেননি। প্রায় ৬৫ লক্ষ মানুষের দেশ লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে ওই নামেই সকলে চেনে: ব্রাদার লিডার!

Description: http://www.anandabazar.com/archive/1110312/13rabipro1.gif
ব্রেকিং নিউজ: ত্রিপোলি
২০০৯ সালের সেই ১ সেপ্টেম্বর, গাদ্দাফির বিপ্লবের চার দশক পূর্তির উৎসবে ত্রিপোলিতে কার না আসার কথা ছিল? মঞ্চে গাদ্দাফির সঙ্গেই থাকবেন আল মাগরাহি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ফরাসি প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি। রাশিয়ার ভ্লাদিমির পুতিন-ও আসবেন বলে জানানো হয়েছিল! কিন্তু এই রাষ্ট্রনেতারা কেউই সে দিন ত্রিপোলিতে যাননি। কূটনৈতিক মহলে কানাকানি ছিল, আল মাগরাহির মতো সন্ত্রাসবাদীর সঙ্গে এক মঞ্চে বসতে চান না বলেই তাঁদের এই সিদ্ধান্ত। ৮৮ সালে ২৪৩ জন যাত্রী ও ১৬ জন কেবিনকর্মী নিয়ে মাঝ আকাশে বিস্ফোরণে প্যান অ্যামের বিমান ধ্বংস হওয়ার ঘটনা কেউ ভোলেননি। আল মাগরাহি-ই তো ওই বিমানে বিস্ফোরক-বোঝাই স্যুটকেস রেখে দিয়েছিলেন।

ফ্ল্যাশব্যাক: ফ্লাইট ১০৩
২১ ডিসেম্বর, ১৯৮৮। হিথরো থেকে ঠিক সময়েই নিউ ইয়র্কের জন এফ কেনেডি বিমানবন্দরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিল প্যান অ্যামের ফ্লাইট ১০৩। কিছুক্ষণ পরেই বিমান উঠে গেল ৩১ হাজার ফুট ওপরে, আচমকা যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। স্কটল্যাণ্ডের লকারবি অঞ্চলে আগুনে দাউদাউ করে জ্বলতে জ্বলতে ভেঙে গুঁড়িয়ে পড়ল সেই বিমান। ভিতরের প্রতিটি মানুষ ততক্ষণে পোড়া লাশ। টানা কয়েক বছর চলল তদন্ত। দেহাংশ, যন্ত্রাংশ সব মিলিয়ে ১০ হাজার টুকরোর কম্পিউটার-বিশ্লেষণ, হেলিকপ্টারে ঘটনাস্থল তন্নতন্ন করে দেখা। অবশেষে তদন্তকারীদের সিদ্ধান্ত, বিমানের কার্গো হোল্ডে একটি স্যুটকেসে বিস্ফোরক ছিল। স্যুটকেসটিতে ঝলসানো জামাকাপড়, সেগুলি মাল্টায় তৈরি। মাল্টার ব্যবসায়ী টোনি গুচ্চি জানালেন, লিবিয়ার এক নাগরিক তাঁর থেকে ওই জামাকাপড় কিনেছিলেন। তাঁর নাম আবদেল বাসেত আল মাগরাহি! 

এখানেই শেষ নয়। বিস্ফোরকের ঝলসে যাওয়া টাইমারটি ছিল মেবো নামে এক সুইস সংস্থার তৈরি। সংস্থার কর্মী লুম্পার্ট আদালতেই আল মাগরাহিকে শনাক্ত করলেন। স্কটল্যাণ্ডের আদালত সাজা দিল, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড!
আট বছর আগে, ২০০৩ সালের অগাস্ট মাসে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে পাঠানো এক চিঠিতে লিবিয়া সেই বিমান বিস্ফোরণের দায়িত্ব স্বীকার করে নিল। আর সন্ত্রাস, খুনোখুনি নয়, জানালেন গাদ্দাফি। মাগরাহিও ততদিনে প্রস্টেট ক্যান্সারে ভুগছেন, মানবিকতার খাতিরে তাঁকে ছেড়ে দিল স্কটল্যাণ্ড। সাইফ আল ইসলাম আল গাদ্দাফি নিজে স্কটল্যাণ্ড থেকে ব্যক্তিগত বিমানে জাতীয় বীরকে ত্রিপোলিতে নিয়ে এলেন।
কোন গোপন বোঝাপড়ায় ব্রিটেন ছেড়ে দিল আল মাগরাহিকে? লিবিয়ার খনিজ তেল? প্রশ্নটা আজও ওঠে। আর, গত মাসে লিবিয়ায় সরকার বনাম বিরোধী সংঘর্ষ শুরুর পর লিবিয়ার প্রাক্তন বিচারসচিব মুস্তাফা মোহাম্মদ সাঙ্ঘাতিক এক বোমা ফাটিয়েছেন। আল মাগরাহিকে ওই অন্তর্ঘাতের নির্দেশ নাকি গাদ্দাফিই দিয়েছিলেন!

বার্লিন, ১৯৮৬
সত্যিই কোনও রাষ্ট্রনেতা এ ভাবে যাত্রীবিমান উড়িয়ে দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন? লকারবিতে বিমান বিস্ফোরণেরও আগের দুটো বছর পিছিয়ে যাওয়া যাক! ৫ এপ্রিল, ১৯৮৬। বার্লিনের ঘড়িতে তখন রাত ১টা ৪০। উইকএণ্ডের সেই রাতে শহরের লা বেল ডিস্কোথেক-এ নাচগান আর স্ফুর্তির তুমুল ফোয়ারা। আর তখনই বিস্ফোরণ! ঘটনাস্থলেই তিন জনের মৃত্যু, ২২৯ জন আহত। প্রাণে বাঁচলেও অনেকেই সারা জীবনের জন্য পঙ্গু। আহত ২২৯ জনের মধ্যে ৭৯ জনই মার্কিন। ঠাণ্ডা যুদ্ধের সেই দিনগুলিতে লা বেলই ছিল বার্লিনের মার্কিন সেনাদের প্রিয় ডিস্কোথেক।
ঠাণ্ডা যুদ্ধের অবসানে, লা বেল বিস্ফোরণ নিয়ে এখন দুনিয়ার হাতে অনেক তথ্য। ভেরোনা চানা এবং আন্দ্রিয়া হাসলার নামে দুই মহিলা এক ট্রাভেল ব্যাগে বিস্ফোরক নিয়ে ডিস্কোথেকে ঢুকেছিলেন, ব্যাগটি রেখে তাঁরা বেরিয়ে আসেন। ভেরোনা চানার বার্লিনের ফ্ল্যাটেই বিস্ফোরক এবং টাইমার বাঁধার কাজ হয়েছিল। 

ভেরোনা চানার স্বামী আলি চানা বার্লিনে লিবিয়ান দূতাবাসের কর্মী ছিলেন। ষড়যন্ত্রের তিনিও এক প্রধান অংশীদার। এমনকী বিস্ফোরণের আগে ত্রিপোলি থেকে তাঁর কাছে রেডিয়ো-বার্তাও পৌঁছেছিল। সুরা আর নাচের আসরে মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়তে পড়তে কী ভাবছিল সেই নাইটক্লাব? লণ্ডন শহরের সেই দৃশ্যটা! দূতাবাসের ভিতর থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি, মাটিতে লুটিয়ে পড়ছেন ইয়োভোনে ফ্লেচার নামে এক মহিলা পুলিশকর্মী!
Description: http://www.anandabazar.com/archive/1110312/13rabipro2.jpg
লণ্ডন, ১৯৮৪
গাদ্দাফির শাসনের বিরুদ্ধে সে-দিন লণ্ডনের লিবিয়ান দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ জমায়েত। ত্রিপোলিতে দুই ছাত্র গাদ্দাফির সমালোচনায় মুখর হয়েছিল, শাস্তি হিসেবে তাদের ফাঁসি দেওয়া হবে। তার বিরুদ্ধেই বিক্ষোভ।
লিবিয়ার দূতাবাসের নাম এখন লিবিয়ান পিপলস ব্যুরো। পেশাদার কূটনীতিকরা নেই, তাঁদের বদলে গাদ্দাফি-অনুগত বিপ্লবী কমিটির লোকজনেই ভর্তি দূতাবাস। সেখান থেকে ব্রিটিশ পুলিশকে জানানো হয়েছে, ঝামেলা দেখলে তাঁরাও ছেড়ে কথা বলবেন না।
আইনশৃঙ্খলা বজায় রাখতে তাই সেখানে তিরিশ জন পুলিশকে পাঠিয়েছে স্কটল্যাণ্ড ইয়ার্ড, ইয়োভোনে ফ্লেচার তাঁদেরই এক জন।
বিক্ষোভকারীদের স্লোগানে দূতাবাস-চত্বর তখন মুখর। পুলিশ ব্যারিয়ার তৈরি করে বিক্ষোভকারীদের ঠেকিয়ে রেখেছে, আচমকা দূতাবাসের দোতলা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে গুলি। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন ইয়োভোনে। লিবিয়ার রেডিয়োতে ততক্ষণে খবর, জঙ্গিরা দূতাবাস ঘিরে রেখেছিল, আত্মরক্ষার কারণে দূতাবাসের কর্মীরা গুলি চালাতে বাধ্য হয়েছেন।
বহু পরে, লকারবি কাণ্ডের দায় ঘাড়ে নেওয়ার সময় লিবিয়া এই দায়টিও স্বীকার করে!

ঘাতকের চোখে পলক পড়ে না
লিবিয়ার ব্রাদার লিডার এ রকমই। ইরাকের সাদ্দাম হোসেন বা আল কায়দা, তালিবানদের মতো তিনি সরাসরি যুদ্ধ ঘোষণা করেননি। কিন্তু অনেক নিরীহ, নির্দোষ নাগরিককে নিঃশব্দে খতম করে দিয়েছেন।
১৯৭৩ সালের কথা ধরতে পারেন। ইজরায়েলের ২৫ বছর পূর্তি। ব্রিটেনের সাউদাম্পটন থেকে ইজরায়েলের হাইফা বন্দরের দিকে রওনা দিয়েছে কুইন এলিজাবেথ-২ নামের এক জাহাজ। যাত্রীরা সকলে ইহুদি, ইজরায়েলের সুবর্ণজয়ন্তীতে যোগ দিতে যাচ্ছেন তাঁরা। লিবিয়ার হাতে তখন সাময়িক ভাবে মিশরের এক সাবমেরিন রয়েছে। তাদের গাদ্দাফির নির্দেশ, টর্পেডো চার্জ করে ওই জাহাজ উড়িয়ে দিতে হবে। মিশরের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত ঘটনাটা জানতে পেরে তখনই সেই সাবমেরিনকে আলেকজান্দ্রিয়ার নৌঘাঁটিতে ফিরে আসার নির্দেশ দেন। পুরো শয়তান একটা লোক, সত্তর দশকেই গাদ্দাফি সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন সাদাত।
ইজরায়েলের সঙ্গে গাদ্দাফির সেটাই প্রথম সঙ্ঘাত নয়। ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিক! এক সকালে মুখে কালো কাপড়, হাতে কালাশনিকভ রাইফেল নিয়ে কিছু আততায়ী ইজরায়েলের ১১ জন অ্যাথলিটকে অলিম্পিক ভিলেজ থেকে অপহরণ করে। পণবন্দি হিসাবে নিয়ে গিয়ে তাঁদের গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়। আততায়ীরা ছিল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর নামে প্যালেস্তাইনি এক গুপ্তসংগঠনের সদস্য। লিবিয়ার সঙ্গে ঘটনার সরাসরি যোগ নেই। কিন্তু ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরকে উদার হাতে অর্থসাহায্য করতেন গাদ্দাফি। 

অর্থাভাব নেই গাদ্দাফির। দুনিয়ায় খনিজ তেলের নবম বৃহত্তম ভাণ্ডার লিবিয়ার মাটির নিচে। সারা দুনিয়ায় প্রতিদিন ৮ কোটি ৮০ লক্ষ ব্যারেল অশোধিত তেল দরকার হয়, তার মধ্যে ১৭ লক্ষ ব্যারেল আসে লিবিয়ার ভাঁড়ার থেকে। আর সেই খনিজ তেল বিক্রি করেই লিবিয়ার ভাণ্ডারে ১৪০,০০ কোটি ডলারের বৈদেশিক মুদ্রা। মিশরের পর লিবিয়ায় গোলমাল শুরু হতেই বিশ্ববাজারে অশোধিত তেলের দাম কেন বেড়ে গেল, তা এতক্ষণে নিশ্চয় পরিষ্কার। তেল বিক্রির এই বিপুল অর্থ মুয়াম্মার গাদ্দাফির ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা পূরণের হাতিয়ার। গাদ্দাফির ধারণা, আফ্রিকার মরুভূমিতে তিনিই রাজা। তাঁর বেদুইন আলখাল্লার ওপরে তাই ইউনাইটেড স্টেটস অব আফ্রিকা নামে এক কাল্পনিক রাষ্ট্রের চিহ্ন। সিয়েরা লিয়োনে, চাদ, সোমালিয়া, সুদান... গৃহযুদ্ধে রক্তাক্ত এই সব দেশে তেল বিক্রির অর্থে গেরিলাদের অস্ত্র কিনে দেন ব্রাদার লিডার
শুধু লকারবি নয়। ১৯৮৯ সালে সাহারা মরুভূমিতে ১৫৬ জন যাত্রীকে নিয়ে আছড়ে পড়েছিল প্যারিসগামী ফ্লাইট ৭৭২। তারও কার্গো হোল্ডে বোমা রাখা ছিল। চাদে তখন গৃহযুদ্ধ চলছিল। সরকারবিরোধী গেরিলাদের এ ভাবেই সাহায্য করেছিল লিবিয়া। প্যারিসের আদালত পরে রায় দিয়েছিল, ঘটনায় সরাসরি যুক্ত গাদ্দাফির শ্যালক, লিবিয়ার গুপ্তচর বিভাগের প্রধান আব্দুল্লাহ সেনসুই।

বিমানহানা
কাঁহাতক এই উন্মাদকে সহ্য করা যায়? বার্লিনের ডিস্কোয় বিস্ফোরণের পর গাদ্দাফিকে পাগলা কুকুর বলে অভিহিত করেছিলেন তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রেগান। ঘটনার এক সপ্তাহের মধ্যে তাই লিবিয়ায় মার্কিন বিমানের হানা। রাত দুটোয় উড়ে এল ১৮টা বোমারু বিমান। ত্রিপোলি ও বেনগাজিতে গাদ্দাফির প্রাসাদে বিমান থেকে আছড়ে পড়ল বোমা, কোনও ক্রমে প্রাণে বেঁচে গেলেন ব্রাদার লিডার। জাতিসংঘ জারি করল অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, লিবিয়ার দুর্দশা তখন সাঙ্ঘাতিক। 

নব্বই দশকের শেষাশেষি ছবিটা বদলে গেল। দক্ষিণ আফ্রিকার নেলসন ম্যাণ্ডেলা এবং জাতিসংঘের তৎকালীন মহাসচিব কোফি আনান দফায় দফায় ত্রিপোলি গিয়ে গাদ্দাফির সঙ্গে বৈঠকে বসলেন। আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞায় কোণঠাসা গাদ্দাফি স্বীকার করে নিলেন তাঁর বিভিন্ন ভুলের দায়। 

দুনিয়া তারপর ভাবছিল, গাদ্দাফি বদলে গিয়েছেন। এখন তিনি ওসামা বিন লাদেনকে গ্রেফতারের জন্য ওয়ারেন্ট জারির কথা বলেন। যাবতীয় শত্রুতা ভুলে ৯/১১-র পরে আহত মার্কিনদের জন্য রক্ত দিতে আহ্বান জানান। আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের কাছে তাঁর অস্ত্রভাণ্ডার উন্মুক্ত করে জানান, লিবিয়া আর পরমাণু-অস্ত্র তৈরির প্রকল্প নেবে না। এমনকী, খাদ্য-নিরাপত্তা নিয়ে রাষ্ট্রপ্রধানদের সঙ্গে শীর্ষবৈঠকে বসেন। 

সত্যিই পাল্টে গিয়েছেন গাদ্দাফি? তা হলে কেন লিবিয়াতে এই অবস্থা? কেন তিউনিসিয়ার আবেদিন বেন আলি বা মিশরের হোসনি মুবারকের মতো মানুষের দাবি মেনে নিলেন না তিনি? উল্টে প্রকাশ্যে হুমকি দিলেন, আরশোলা ও ইঁদুরের কাছে নতিস্বীকার করবেন না। আমি এই লিবিয়াকে তৈরি করেছি। দরকারে তাকে শেষ করে তার পর নিজে মরব, বলছেন ব্রাদার লিডার।
ভিতরে ভিতরে তা হলে বদলাননি গাদ্দাফি? কেমন মানুষ তিনি?

সেবিকাসঙ্গে
Description: http://www.anandabazar.com/archive/1110312/13rabipro3.jpg
৬৮ বছরের ব্রাদার লিডার যেখানেই যান, সঙ্গে ৩৮ বছরের এক সেবিকা। ইউক্রেনের মেয়ে তিনি। ডিভোর্সি, এক কন্যার মা। নাম গালিনা কোলোতনিকা! গালিনাকে ছাড়া গাদ্দাফি কখনও কোথাও যান না। কতক্ষণ কাজে ব্যস্ত থাকতে হবে, কখন উঠে ওষুধ এবং খাবার খেতে হবে সবই ওই সুন্দরী তরুণীর নখদর্পণে। জাতিসংঘের বৈঠকে যোগ দিতে গত বছর ত্রিপোলি থেকে নিউ ইয়র্কে আসছেন গাদ্দাফি, সফরসঙ্গিনী গালিনা তখনও ভিসা পাননি। গাদ্দাফি সরাসরি নিউইয়র্কে না এসে লিসবনে একদিন অপেক্ষা করলেন। খবর এলো, ভিসা তৈরি! প্রাইভেট জেট ত্রিপোলি
উড়ে গেল গালিনাকে নিয়ে আসতে। পরদিন লিসবন থেকে গালিনাকে সঙ্গে নিয়ে নিউ ইয়র্ক উড়ান। এমনিতে গালিনা গাদ্দাফিকে পাপা বলে ডাকেন। কিন্তু অনেকেরই ধারণা, দুজনের মোটেও বাবা-মেয়ের সম্পর্ক নয়। 

আর তাঁর সুন্দরী দেহরক্ষীরা? রাফ অ্যাণ্ড টাফ সেনা-অফিসারেরা নন, ঠোঁটে লিপস্টিক, শরীরে সুগন্ধি পারফিউম ছড়ানো প্রায় ৩০ জন সুন্দরী গাদ্দাফির দেহরক্ষী। কিন্তু সেই সুন্দরীদের হাতেও এ কে ৫৬, প্রত্যেকেই লক্ষ্যভেদে নিপুণ।
মরুভূমির গাদ্দাফা উপজাতির সন্তান এখনও জলের ওপর উড়ানের সময় ভয়ে চোখ বুজে থাকেন। উচ্চতায় ভয় পান, টানা আটঘণ্টার বেশি বিমানযাত্রার ধকল তাঁর সয় না। বহুতল বাড়ির লিফ্‌ট বা এলিভেটরে চড়তে নারাজ। সিঁড়ি? একসঙ্গে ৩৫ ধাপের বেশি উঠলে মাথা ঘোরে। সেই জন্যই নিউইয়র্ক, লণ্ডন, প্যারিস, রোম যেখানেই যান না কেন, সঙ্গে নিয়ে যান তাঁর নিজস্ব বিলাসবহুল তাঁবু। ওটাই মুয়াম্মার গাদ্দাফির স্টাইল!

গাদ্দাফির সন্ততি
মুয়াম্মার গাদ্দাফির প্রথম স্ত্রী ফতিহা ছিলেন স্কুলশিক্ষিকা। তাঁর সঙ্গে বিয়ের ফলে গাদ্দাফির এক পুত্র। মোহাম্মদ আল গাদ্দাফি। মোহাম্মদ এখন লিবিয়ার পোস্ট অ্যাণ্ড টেলিকম সংস্থার চেয়ারম্যান, দেশের যাবতীয় সেলফোন ও স্যাটেলাইট অপারেশনের দায়িত্ব তাঁর হাতে। পুত্র ও পরিবারবর্গের হাতে এ ভাবেই দেশটাকে ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়েছেন গাদ্দাফি। সাফিয়া আল গাদ্দাফি ছিলেন পেশায় গালিনা কোলোতনিকার মতোই এক সেবিকা। তিনিই গাদ্দাফির দ্বিতীয় স্ত্রী। এই দম্পতির সাত সন্তান। বড় ছেলে সাইফ আল ইসলাম আল গাদ্দাফিকে আমরা কাহিনির শুরুতেই বিমানবন্দরে দেখেছি। লণ্ডন স্কুল অব ইকনমিক্সে সুশাসন নিয়ে ডক্টরেট করেছেন। এবং দেশে ফিরে অবাধ্য ইঁদুর-বাঁদরদের মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছেন। সাইফের পরের ভাই সাদি গাদ্দাফি এখন লিবিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের কর্তা। আর এক ভাই মুতাসিম দেশের নিরাপত্তাপ্রধান। গাদ্দাফির আর এক ছেলে হানিবল লিবিয়ার জাহাজ কর্পোরেশনের কর্তা। জাহাজেই তেল রফতানি হয় কি না! হানিবল বেশ রগচটা গোছের। প্যারিসে বান্ধবীকে পিটিয়েছেন বলে অভিযোগ ছিল। সুইটজারল্যাণ্ডের হোটেলেও দুই মহিলাকর্মীকে নিগ্রহের দায়ে এক বার তাঁকে গ্রেফতার করা হয়েছিল। প্রতিবাদে গাদ্দাফি লিবিয়ার সুইস নাগরিকদের বন্দি করেছিলেন, সুইটজারল্যাণ্ডে তেল রফতানি করবেন না বলে হুমকি দিয়েছিলেন। আর এক ছেলে খামিস পুলিশ অফিসার। লিবিয়ার জনতার ওপর ট্যাঙ্ক, কামান আর বোমাবর্ষণের দায়িত্বে তিনি-ই।

আল জামাহিরিয়া
মাওয়ের যেমন রেড বুক, গাদ্দাফির তেমন গ্রিন বুক। দুই খণ্ডের ওই গ্রিন বুকেই রয়েছে গদ্দাফির সোসালিস্ট পিপলস লিবিয়ান আরব আল জামাহিরিয়ার দর্শন। গ্রিন বুকের কারণেই লিবিয়ার পতাকার রং সবুজ। ত্রিপোলির প্রধান চত্বরের নাম গ্রিন স্কোয়ার। আল জামাহিরিয়া? লিবিয়ার সরকারি নাম। আরবি শব্দবন্ধটির মানে, মানুষের গণতন্ত্র। গাদ্দাফির সেই গণতান্ত্রিক দর্শন অনুযায়ী, লিবিয়ায় কোনও সংবিধান নেই। রাজনৈতিক দল, ভোটাভুটি নিষিদ্ধ। প্রশাসন, বিচারবিভাগ ইত্যাদির পৃথক অস্তিত্বও নেই। রয়েছে কতকগুলি জনসাধারণের কমিটি। শহরে-শহরে সেই কমিটি কোথাও আইনশৃঙ্খলা দেখে, কোথাও বা অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত নেয়। সবার ওপরে গাদ্দাফি ও তাঁর ১২ জন সদস্যের বিপ্লবী কাউন্সিল
দেশে সরকারি কোনও রাজধানী নেই। ত্রিপোলি, বেনগাজি, বাহাত, কুফরা প্রতিটি শহরই সমান গুরুত্বপূর্ণ। লিবিয়ার বিদ্রোহ কেন মিশর বা তিউনিশিয়ার মতো শান্ত থাকল না, তার কারণ এখানেই। বেনগাজি, তোবরুকের মতো শহরে বিদ্রোহীদের সঙ্গে স্থানীয় সামরিক কমিটি হাত মিলিয়েছে। ফলে বিদ্রোহীদের হাতেও এখন স্নাইপার, রকেট লঞ্চার আর সাবমেশিনগান। আর সেই ইঁদুরদের পিষে মারতে গাদ্দাফির বাহিনীও ঝাঁপিয়ে পড়েছে সমান তালে। মিশরে সৈন্যরা স্বদেশি জনগণের ওপরে হামলা চালায়নি। কিন্তু লিবিয়ায় বেশির ভাগই আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকে আসা ভাড়াটে সেনা। 

বেদুইন সন্তান মুয়াম্মার গাদ্দাফির গুণ একটিই। ইসলামি মৌলবাদকে তিনি প্রশ্রয় দেননি। কিন্তু সেটাই তো সব নয়। তাঁর সৌজন্যে লিবিয়ার তেল বিক্রির অর্থের বেশিটাই চলে গিয়েছে বিভিন্ন দেশে গুপ্তঘাতকদের পকেটে।
আর বাকিটা? দেশের মানুষকে নিখরচায় শিক্ষা, স্বাস্থ্য আর বাসস্থান দেয় লিবিয়া। শিক্ষিতের হার ৮২%। কিন্তু পরিসংখ্যানে ঘাবড়ালে চলবে না। শিক্ষা মানে আরবি ভাষা। কয়েক বছর আগেও লিবিয়ায় ইংরেজি শেখানো হত না। সাম্রাজ্যবাদের ভাষা যে! 

স্বাস্থ্যও তথৈবচ। হাতে অর্থ থাকলে লোকে চিকিৎসার জন্য প্রতিবেশী দেশ মিশরে পাড়ি দেন। আর বাসস্থান মানে, কংক্রিটের কিছু ঘুপচি ঘর। এরই মধ্যে আছে একুশে আইনের মতো ৭১ নম্বর আইন। বিপ্লবী কাউন্সিলের উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করলেই মৃত্যুদণ্ড। মানবাধিকারের ধার ধারে না গাদ্দাফির গণতন্ত্র!
সেই গণতন্ত্রে এই যুদ্ধ-ই চলার কথা। ভাড়াটে সৈন্যদের ট্যাঙ্ক জিতবে কি না, অন্য গল্প। কিন্তু দেশের মানুষের কাছে চিরকালের জন্য হেরে গিয়েছেন মুয়াম্মর গদ্দাফি!
শিল্পী: অনুপ রায়

1 comment:

  1. গাজা খাইয়া লিখছেন, লেখায় কোনো নিরপেক্ষতা নাই, কই তার একটা ভালো দিক তো লিখলেন না৷ শুধু তার দোস গুলো দিয়ে তাকে উপস্থাপন করেছেন...

    ReplyDelete