বাংলাদেশে নজরুল জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার ফলে তাঁর প্রতি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ও সরকারি উদ্যোগে প্রতিবছর যত ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়, তা একদিকে কবিকে মর্যাদা দান করে; অন্যদিকে সংস্কৃতিমান মানুষের চর্চার নতুন নতুন দুয়ার উন্মুক্ত করে_এ কথা নিঃসংকোচে বলা যায়। কবির সৃষ্টিকর্মকে সাধারণ মানুষের মাঝে পৌঁছে দেওয়া বা তাদের আগ্রহী করে তুলতেও এই সব অনুষ্ঠান বেশ ভূমিকা রাখে।
উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির অবশ্য এ ধরনের আয়োজনের শেষ নেই, কথায় আছে না_বারো মাসে তেরো পার্বণ। ধর্মীয় উৎসব, ফসল ও ঋতু উৎসব, ব্যক্তিজীবনের জন্ম-মৃত্যু উৎসব, কৃত্যানুষ্ঠান_আরো কত কী! এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এবং পরবর্তীকালের চলার ছন্দ খুঁজে নেয়। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর কমতি হয়নি। বরং উদ্যোগের নানা পর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নজরুলকে আরো জানা-বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, সম্প্রতি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এতে নজরুলকে নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ নজরে পড়েছে, যেমন_ছয়-সাত শর মতো স্বরলিপি প্রণয়ন করা হয়েছে, গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে সিডিতে বাজারজাত করা হয়েছে, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গায়কি প্রশিক্ষণ, জাদুঘর নির্মাণ ও রাজধানীর মোড়ে মোড়ে স্মৃতিস্মারকসহ নানা উদ্যোগে নজরুল বেশ শক্ত-সমর্থ হয়ে জাতির সামনে অবস্থান নিয়েছেন।
এসব কাজ করতে গিয়ে অবশ্য বিভিন্ন পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের ফাঁকিজুঁকি, দুর্নীতি, প্রতারণা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবও কম চোখে পড়েনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিমাত্রাদানেরও চেষ্টা চলেছে, যা দেখে নজরুলই হয়তো বিব্রত হতেন_এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ কথা সবারই জানা যে ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলামী গান রচনার জন্য নজরুলকে মুসলিম জাগরণের কবি খ্যাতি দিয়েছিল। এদের মধ্যে এখনো তুলনা চলে যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের আর নজরুল আমাদের। অথচ নজরুল যতগুলো শ্যামাসংগীত ও কীর্তন লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের গানে তার সিকিভাগও প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া নজরুল ছিলেন আদর্শগতভাবে সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী, আর রবীন্দ্রনাথ অন্তত হিন্দু ছিলেন না; জন্মগতভাবেই না।
অর্থাৎ মানুষের সীমাবদ্ধ পরিসরে যার যে বিবেচনাবোধ, নজরুলকে তারা সেভাবেই মূল্যায়ন করতে চেয়েছে। এটা দোষের কিছু নয়। কারণ নজরুলের ভেতরেই বহুরূপী প্রতিভা ছিল_গান, নাটক, কবিতা, বিদ্রোহ, প্রেম, গণচেতনা, রাজনীতি, ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। এই সব প্রতিভা ও বোধ নজরুলভক্তদের কাছে সার্বিকভাবে বিবেচিত না হয়ে একেকজনের কাছে একেক রকমের প্রভাব ফেলেছে। এ জন্য নজরুলকে সার্বিকভাবে উপস্থাপনের জন্য প্রাজ্ঞজনের বেশ দায়ভার রয়ে গেছে। অনেকে ভাবছেন, এই গৎ বাঁধা লেখনীর হেতু কী? প্রতিবছর এ দেশের পত্রপত্রিকায়, জার্নালে শত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ তো বেরোয়; তা থেকে এর স্বাতন্ত্র্য কোথায়? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে এতে নজরুলের অবদান নিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না। এবং নতুন কোনো আবিষ্কার বা তথ্যও পাওয়া যাবে না। এখানে কথা হবে সাম্প্রতিক সময়ের বিবেচনায় সংগীতে সৃজনশীলতার চর্চা কেমন হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে নজরুলের প্রয়োজন কিভাবে কতটুকু থাকতে পারে, সেই বিষয়ে।
আধুনিক গানের ব্যাপক ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার কারণে অতিসাম্প্রতিককালে নজরুলসংগীতের প্রসার অনেকটা কমে এসেছে। চলচ্চিত্র ও অডিও ভিজ্যুয়ালের এই যুগে বিনোদনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে দ্রুতগতিতে। স্যাটেলাইট চ্যানেল ঘরে ঘরে আসায় বিশ্বসংগীত সম্পর্কে ধারণা হয়েছে অন্দরমহলের মানুষেরও, এসেছে নানা ধরনের সুবিধাজনক ও সহজলভ্য অডিও সিস্টেম; যেমন_মোশন পিকচার এক্সপার্ট (এমপিথ্রি), ইন্টারনেট থেকে সংগীত ডাউনলোডের বিশাল মুক্তবাজার। ফলে সহজলভ্যতা ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের কারণে প্রচলিত ধারার সংগীত দ্রুত গুরুত্ব হারাচ্ছে। প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি সুবিধা করে দিয়েছে হোম থিয়েটার ও কম্পিউটারনির্ভর ডিজিটাল স্টুডিও দান করে। প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে লিখতে ও শব্দ ধারণ করতে পারছে। নানা ধরনের সংগীত করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে হাল জামানার এই রমরমা গোলকধাঁধায় নজরুলসংগীত কেন, শতবর্ষের প্রচলিত অজস্র গানের গুরুত্ব কমে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
বলছি না যে গুরুত্ব হারাচ্ছে, তবে সংকোচনে তো ভয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়। সংগীত ও অডিওনির্ভর সৃজনশীলতার এ রকম দুরন্তপনা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করা যায়নি। নজরুল ২০-২২ বছরে সাড়ে তিন হাজার গান লিখেছিলেন_এটিও বিস্ময়কর ছিল। ফলে সম্প্রতিকালের এই কাণ্ডকে খারাপ চোখে দেখার কিছু নেই; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-নজরুলও দেখতেন না (যদিও এ সময় তাঁদের ভক্তদের অনেকেই দেখেন)। তবে প্রশ্ন হলো, সৃজনশীল এই কাজগুলো মানোত্তীর্ণ হচ্ছে কি না।
প্রশ্নটির সঙ্গে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছুটা হলেও যোগসূত্র রয়েছে। এ দেশে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান বিভাগের মধ্যে হতে পারত ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া বা কীর্তন_এ রকম একেকটি প্রধান বিভাগ; তা না হয়ে হয়েছে লোকসংগীত বিভাগ। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের বিভাগ হতে পারত খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরি ইত্যাদি; বাদ্যের ক্ষেত্রে হতে পারত ততবাদ্য বা আনদ্ধবাদ্য বিভাগ। আরো অনেক বিভাগ হতে পারত, যেমন_মিউজিক হিস্টরি, মিউজিক কম্পোজিশন, সাউন্ড টেকনোলজি ইত্যাদি। কিন্তু যেখানে আধুনিক গানের বিভাগ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে হলো রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত বিভাগ ইত্যাদি। এ-জাতীয় বিভাগ স্বতন্ত্র না হয়ে আধুনিক গানের বিভাগে যুক্ত হওয়াই উপযুক্ত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা হয়নি। যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে লোকসংগীতের একেকটি ধারা গড়ে উঠেছে, তা একটি বিভাগ বানিয়ে ঠাসাঠাসি করা হচ্ছে। আর ব্যক্তি নামে বিভাগ করে তার সঙ্গে অন্য অনেক প্রবক্তার সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগবঞ্চিত করে প্রত্যেককেই নিঃসঙ্গ করে তোলা হচ্ছে।
যা হোক, নজরুলসংগীত বিভাগ নাম দিয়ে যেহেতু বিভিন্ন সংগীত একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে শেখানো হয় নজরুলের বিভিন্ন গান, যেমন_কাব্যগীতি, রাগাশ্রিত, ভজন, কীর্তন, ইসলামী গান ইত্যাদি থেকে নির্বাচিত কিছু গান; কিন্তু নজরুল কিভাবে গান লিখতেন, কী প্রয়োজনে লিখতেন, কিভাবে সুর সংগ্রহ করতেন, বিশেষ করে নজরুল যে যে সংগীতাঞ্চল থেকে সুর টেনেছেন, সেই আঙ্গিকগুলো সরাসরি এখানে অন্তর্ভুক্ত কি না। অর্থাৎ নজরুলের সৃষ্টি ও কর্মপরিধি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চার প্রসঙ্গ আসে কি না। যেমন_নজরুল চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখতেন, এইচএমভিতে বাণিজ্যিকভাবে গান লিখতেন, সুর করতেন। বর্তমানে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ-জাতীয় প্রচেষ্টা আছে কি না। নজরুল নিয়ে বিভাগ মানে তাঁর সংগীত শেখানোর পাশাপাশি আদর্শ অনুশীলনের একটা পর্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। নজরুলসংগীত শেখা যেমন জরুরি, তাঁর সৃষ্টির প্রেষণা ও প্রেক্ষাপটকে উপলব্ধি করে নতুন গানের মান বিবেচনা করা ততোধিক জরুরি। কিন্তু খোদ নজরুলপ্রেমীদের বরাবরই সৃষ্টির প্রতি উন্নাসিকতার কারণে সৃষ্টিশীল শিক্ষার্থীরা নজরুলসংগীতের শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নেয় না।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি, আমি নিজেই সংগীত রচনার শুরুর দিকে আইডল হিসেবে নজরুলসংগীত শিখতে গিয়েছিলাম। সেখানে নিজের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কথা বলায় নানা ধরনের হেঁয়ালি ও তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়েছিল। ভালো কিছু সৃষ্টির জন্য পূর্বজ প্রতিভার প্রভাব প্রয়োজন হয়। গ্যেটের ওপর যেমন ছিল ক্রিস্টোফার মার্লো প্রভাব, রবীন্দ্রনাথের ওপর ছিল লালন ও সূফী কবিদের প্রভাব, নজরুলের জন্য ছিল রবীন্দ্রনাথ, খৈয়াম। প্রতিষ্ঠান অবশ্য এসব প্রভাবের শিক্ষা দেয় না; তবে সমর্থনমূলক মানসিকতার দীক্ষা দেয়। নজরুল রুটি বানাতেন বলে শিক্ষার্থীকে রুটি বানানো শেখাতে হবে, এমন কথা বলা হচ্ছে না এখানে; বরং রুটি বানানোর জীবন-বাস্তবতা ও তার মর্ম জানা শিক্ষার্থীর জন্য অত্যাবশ্যক, যা আমাদের নেই। কারণ কিছুসংখ্যক গুরুজনের মনোভাব হলো, নজরুলের মতো এত বড় প্রতিভারই ঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, তরুণ গীতিকার আবার কে! আর করবেই বা কী!
এটা বিবেচনা করতে হলে কবিতা ও চিত্রকলার দিকে তাকানো যেতে পারে। চিত্ররসিকরা সব সময় পূর্বজ চিত্রকরের চিত্র দেয়ালে টাঙিয়ে সারা দিন বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখে রসোপলব্ধি করে আর ভাবে যে এই শিল্পের চেয়ে ভালো তো আর আঁকতে পারব না, তাহলে এঁকে লাভ কী? অথবা কোনো বড় শিল্পীর আঁকা জনপ্রিয় ছবির অনুকরণে একই ছবি যুগ যুগ ধরে আঁকে কি? কবিদের ক্ষেত্রেও কি একই ব্যাপার? সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলতে যেমন ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ বা চারুকলা বিভাগগুলো কি শুধু পুরনো চিত্রকলার রসতত্ত্বই শেখায়, না নতুন নতুন চিত্র অনুশীলনের তাগিদ দেয়। চারুকলায় তো নতুন সৃষ্টির দক্ষতাই শিক্ষার প্রধান বিবেচনা করা হয়; শুধু জয়নুল-সুলতান-পিকাসোর চিত্রের নান্দনিকতা নিয়েই পড়ে থাকে না। বিশ্বের চিত্রকলার নতুন নতুন দর্শন, তত্ত্ব ও ফর্ম আমদানি করে আন্তর্জাতিক মাত্রা স্থাপন করে। কবিরাও তা-ই করে, কোন দেশে কোন কবিতায় নতুন চিন্তার উদয় হলো, পাল্টাল ভাষার কাঠামো, এগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলে। নাটকে, চলচ্চিত্রে, উপন্যাসেও চলে। শুধু ব্যতিক্রম হলো সংগীত। ঢালাওভাবে না বললেও অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায়। এ দেশে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, বিভিন্ন সংগীত একাডেমীতে নজরুলসংগীত বিভাগ রয়েছে_কোথাও কোনো সৃজনশীল সংগীতের আশ্রয় নেই। ফলে ডিজিটাল যুগে কম্পিউটারের আশ্রয়ে যারা নজরুলসংগীত করবে, তাদের মাথার ওপর খড়্গ থাকায় নিজস্ব পরিকল্পনায় নজরুলগীতি করতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, সুরের বিকৃতির বিষয়ে সবারই আপত্তি আছে। কিন্তু নজরুলসংগীত বলতে কি শুধু তাঁর নির্ধারিত বাণী বা সুরের কাঠামোটাই? এর সঙ্গে কি অন্যান্য সুরযন্ত্র-তালযন্ত্রের প্রয়োগ নেই? সে ক্ষেত্রে কম্পোজিশনের দায়িত্ব নেবে কে? বাজার থেকে হায়ার করা যন্ত্রী এসে বাজিয়ে দিয়ে যাবে? যদি সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান ও সিলেবাসে সৃজনশীলতার আশ্রয় থাকত, তাহলে কেউ গাইত, কেউ বাজাত, কেউ বা মার্কেটিং করত। প্রতিষ্ঠানের ধর্ম তো সার্বিকভাবে প্রস্তুত করে দেওয়া, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা শিল্পীরা তাদের কর্মযজ্ঞে নামলে তখনই অপ্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রী, রেকর্ডিস্ট, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারস্থ হতে হয়।
এ কেমন দুর্ভাগ্যময় শিক্ষা? তবে যদি জানা যেত এসব পরিকল্পনার আওতায় রয়েছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, শুধু প্রতিকূলতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে না; তাহলেও শান্তি পাওয়া যেত। কিন্তু বাস্তব হলো, এসব বিষয়ে কোনো পরিকল্পনামূলক নকশাও তৈরি করতে দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের কথাই ধরা যাক, এখানে নজরুলসংগীত বিভাগ আছে, কিন্তু কোনো রেকর্ডিং স্টুডিও নেই, সংগীত-প্রযুক্তি ও অডিও রেকর্ডিং নিয়ে কোনো অধ্যায় নেই, গানের তাল-সুর সংগীতের জন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র বিভাগ নেই, তবলা প্রশিক্ষকদের বাদনে সহযোগিতা ছাড়া ছাত্রদের স্ব-উদ্যোগে পরিবেশনের কোনো দক্ষতা নেই, আর সংগীতের অভ্যন্তরীণ মেলোডি, কাউন্টার মেলোডি বাজানোর ব্যাকরণ সম্পর্কে বা কম্পোজিশন সম্পর্কে ব্যবহারিক কোনো ধারণা পাওয়ার সুযোগও নেই।
এই উদাহরণ কোনো বিষোদ্গার অর্থে করা হচ্ছে না, কোনো অভিযোগও নয়; এটা পরিস্থিতি, এটা বিশেষজ্ঞ মহলের চিন্তার সীমাবদ্ধতা। এ দেশের সংগীত একাডেমীর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন দুরবস্থা। ফলে যতই জন্ম-মৃত্যু উৎসব হোক, যতই গ্রামোফোন রেকর্ড সংরক্ষণ করা হোক, স্বরলিপি করা হোক, যতই শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোক, সংগীত শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন ছাড়া নজরুলের গানের সম্প্রসারণ হবে না। সম্প্রসারণের জন্য সৃজনশীল মনোনিবেশ থাকলে অপ্রচলিত গানে তরুণদের আগ্রহ বাড়বে। সুর নিয়ে গবেষণা বা কম্পোজিশনের প্রবণতা বাড়বে। ছাত্রছাত্রী নতুনত্বের প্রতি গভীর অনুসন্ধানী হয়ে উঠবে।
নজরুলকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান না হলেও ঘরে ঘরে নজরুলের চর্চায় ক্ষান্তি দিত না কেউ। এত দিনের অবহেলিত বাকরুদ্ধ নজরুলকে তাঁর যথাযোগ্য আসনে বসিয়েছে ব্যক্তিজীবনের ভক্তপ্রাণ মানুষই। এখন প্রতিষ্ঠান হয়েছে, ফলে নজরুলের সৃষ্টিকর্ম একটি শুদ্ধ ও শৃঙ্খলায় এসে পর্যবসিত হবে_এটাই প্রত্যাশা। তবে শৃঙ্খলার নামে শৃঙ্খলিত করার অভিযোগও কম ওঠেনি। প্রতিষ্ঠানের একটি প্রাতিষ্ঠানিক মনোভাব থাকবেই, সেখানে নজরুলকেও কোনো ব্যক্তি হিসেবে দেখার অবকাশ থাকবে না। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে হবে। সেখানে নজরুলের সহযোগী, অনুসারী-অনুচর, বন্ধু-শত্রু, সুরকার, গায়ক-গবেষক_প্রত্যেকের অবদান সংশ্লিষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। নজরুলকে প্রকৃত শ্রদ্ধা করতে হলে এত এত বাজেট করে অনুষ্ঠান করার দরকার হয় না। নজরুলের চেতনা, সময় ও দ্রোহের সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষণকে উপলব্ধি করতে পারলে আজকের তরুণ সমাজের সামনে অবক্ষয়-অন্ধকার দেখা দিত না। নজরুলসংগীত শেখানোর আগে তাঁর জীবন ও সাহসের সার্বিক ধারণা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। তাঁর অন্বেষার ছুটন্ত ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, আর আমরা গাইছি প্রেমগীত। বাজারের সস্তা কাঁচামাল হিসেবে গানগুলো ফেরি করছি। এ বড় অন্যায়।
সূত্র: কালের কন্ঠ : শিলালিপি ২১.০৫.২০১০
উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির অবশ্য এ ধরনের আয়োজনের শেষ নেই, কথায় আছে না_বারো মাসে তেরো পার্বণ। ধর্মীয় উৎসব, ফসল ও ঋতু উৎসব, ব্যক্তিজীবনের জন্ম-মৃত্যু উৎসব, কৃত্যানুষ্ঠান_আরো কত কী! এর মধ্য দিয়েই বাঙালি জাতি নিজেদের জীবন ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে এবং পরবর্তীকালের চলার ছন্দ খুঁজে নেয়। নজরুলের ক্ষেত্রেও এর কমতি হয়নি। বরং উদ্যোগের নানা পর্বে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠে নজরুলকে আরো জানা-বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। তেমনই কয়েকটি প্রতিষ্ঠান নজরুল একাডেমী, নজরুল ইনস্টিটিউট, সম্প্রতি কবি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি। এতে নজরুলকে নিয়ে নানা ধরনের গবেষণামূলক কাজ নজরে পড়েছে, যেমন_ছয়-সাত শর মতো স্বরলিপি প্রণয়ন করা হয়েছে, গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রহ করে সিডিতে বাজারজাত করা হয়েছে, দুর্লভ পাণ্ডুলিপি প্রকাশিত হয়েছে। এ ছাড়া গায়কি প্রশিক্ষণ, জাদুঘর নির্মাণ ও রাজধানীর মোড়ে মোড়ে স্মৃতিস্মারকসহ নানা উদ্যোগে নজরুল বেশ শক্ত-সমর্থ হয়ে জাতির সামনে অবস্থান নিয়েছেন।
এসব কাজ করতে গিয়ে অবশ্য বিভিন্ন পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের ফাঁকিজুঁকি, দুর্নীতি, প্রতারণা, সুষ্ঠু পরিকল্পনার অভাবও কম চোখে পড়েনি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অতিমাত্রাদানেরও চেষ্টা চলেছে, যা দেখে নজরুলই হয়তো বিব্রত হতেন_এমন ঘটনাও ঘটেছে। এ কথা সবারই জানা যে ধর্মপ্রাণ মানুষ ইসলামী গান রচনার জন্য নজরুলকে মুসলিম জাগরণের কবি খ্যাতি দিয়েছিল। এদের মধ্যে এখনো তুলনা চলে যে রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের আর নজরুল আমাদের। অথচ নজরুল যতগুলো শ্যামাসংগীত ও কীর্তন লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের গানে তার সিকিভাগও প্রমাণ করা সম্ভব নয়। তা ছাড়া নজরুল ছিলেন আদর্শগতভাবে সমাজতান্ত্রিক-সাম্যবাদী, আর রবীন্দ্রনাথ অন্তত হিন্দু ছিলেন না; জন্মগতভাবেই না।
অর্থাৎ মানুষের সীমাবদ্ধ পরিসরে যার যে বিবেচনাবোধ, নজরুলকে তারা সেভাবেই মূল্যায়ন করতে চেয়েছে। এটা দোষের কিছু নয়। কারণ নজরুলের ভেতরেই বহুরূপী প্রতিভা ছিল_গান, নাটক, কবিতা, বিদ্রোহ, প্রেম, গণচেতনা, রাজনীতি, ধর্মীয় অসাম্প্রদায়িকতা ইত্যাদি। এই সব প্রতিভা ও বোধ নজরুলভক্তদের কাছে সার্বিকভাবে বিবেচিত না হয়ে একেকজনের কাছে একেক রকমের প্রভাব ফেলেছে। এ জন্য নজরুলকে সার্বিকভাবে উপস্থাপনের জন্য প্রাজ্ঞজনের বেশ দায়ভার রয়ে গেছে। অনেকে ভাবছেন, এই গৎ বাঁধা লেখনীর হেতু কী? প্রতিবছর এ দেশের পত্রপত্রিকায়, জার্নালে শত শত প্রবন্ধ-নিবন্ধ তো বেরোয়; তা থেকে এর স্বাতন্ত্র্য কোথায়? এ ক্ষেত্রে প্রথমেই স্বীকার করে নেওয়া ভালো যে এতে নজরুলের অবদান নিয়ে কিছু পাওয়া যাবে না। এবং নতুন কোনো আবিষ্কার বা তথ্যও পাওয়া যাবে না। এখানে কথা হবে সাম্প্রতিক সময়ের বিবেচনায় সংগীতে সৃজনশীলতার চর্চা কেমন হচ্ছে, সেই প্রেক্ষাপটে নজরুলের প্রয়োজন কিভাবে কতটুকু থাকতে পারে, সেই বিষয়ে।
আধুনিক গানের ব্যাপক ক্ষেত্র সৃষ্টি হওয়ার কারণে অতিসাম্প্রতিককালে নজরুলসংগীতের প্রসার অনেকটা কমে এসেছে। চলচ্চিত্র ও অডিও ভিজ্যুয়ালের এই যুগে বিনোদনের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত হয়েছে দ্রুতগতিতে। স্যাটেলাইট চ্যানেল ঘরে ঘরে আসায় বিশ্বসংগীত সম্পর্কে ধারণা হয়েছে অন্দরমহলের মানুষেরও, এসেছে নানা ধরনের সুবিধাজনক ও সহজলভ্য অডিও সিস্টেম; যেমন_মোশন পিকচার এক্সপার্ট (এমপিথ্রি), ইন্টারনেট থেকে সংগীত ডাউনলোডের বিশাল মুক্তবাজার। ফলে সহজলভ্যতা ও বাণিজ্যিক সম্প্রসারণের কারণে প্রচলিত ধারার সংগীত দ্রুত গুরুত্ব হারাচ্ছে। প্রযুক্তি সবচেয়ে বেশি সুবিধা করে দিয়েছে হোম থিয়েটার ও কম্পিউটারনির্ভর ডিজিটাল স্টুডিও দান করে। প্রত্যেকেই স্বাধীনভাবে লিখতে ও শব্দ ধারণ করতে পারছে। নানা ধরনের সংগীত করে ইন্টারনেটের মাধ্যমে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। ফলে হাল জামানার এই রমরমা গোলকধাঁধায় নজরুলসংগীত কেন, শতবর্ষের প্রচলিত অজস্র গানের গুরুত্ব কমে আসবে, এটাই স্বাভাবিক।
বলছি না যে গুরুত্ব হারাচ্ছে, তবে সংকোচনে তো ভয়ের আশঙ্কা থেকেই যায়। সংগীত ও অডিওনির্ভর সৃজনশীলতার এ রকম দুরন্তপনা দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করা যায়নি। নজরুল ২০-২২ বছরে সাড়ে তিন হাজার গান লিখেছিলেন_এটিও বিস্ময়কর ছিল। ফলে সম্প্রতিকালের এই কাণ্ডকে খারাপ চোখে দেখার কিছু নেই; স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ-নজরুলও দেখতেন না (যদিও এ সময় তাঁদের ভক্তদের অনেকেই দেখেন)। তবে প্রশ্ন হলো, সৃজনশীল এই কাজগুলো মানোত্তীর্ণ হচ্ছে কি না।
প্রশ্নটির সঙ্গে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কিছুটা হলেও যোগসূত্র রয়েছে। এ দেশে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রধান বিভাগের মধ্যে হতে পারত ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া বা কীর্তন_এ রকম একেকটি প্রধান বিভাগ; তা না হয়ে হয়েছে লোকসংগীত বিভাগ। ক্লাসিক্যাল মিউজিকের বিভাগ হতে পারত খেয়াল, ধ্রুপদ, ঠুমরি ইত্যাদি; বাদ্যের ক্ষেত্রে হতে পারত ততবাদ্য বা আনদ্ধবাদ্য বিভাগ। আরো অনেক বিভাগ হতে পারত, যেমন_মিউজিক হিস্টরি, মিউজিক কম্পোজিশন, সাউন্ড টেকনোলজি ইত্যাদি। কিন্তু যেখানে আধুনিক গানের বিভাগ হওয়ার কথা ছিল, সেখানে হলো রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলসংগীত বিভাগ ইত্যাদি। এ-জাতীয় বিভাগ স্বতন্ত্র না হয়ে আধুনিক গানের বিভাগে যুক্ত হওয়াই উপযুক্ত ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তা হয়নি। যেখানে হাজার হাজার বছর ধরে লোকসংগীতের একেকটি ধারা গড়ে উঠেছে, তা একটি বিভাগ বানিয়ে ঠাসাঠাসি করা হচ্ছে। আর ব্যক্তি নামে বিভাগ করে তার সঙ্গে অন্য অনেক প্রবক্তার সঙ্গে তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগবঞ্চিত করে প্রত্যেককেই নিঃসঙ্গ করে তোলা হচ্ছে।
যা হোক, নজরুলসংগীত বিভাগ নাম দিয়ে যেহেতু বিভিন্ন সংগীত একাডেমী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, সেখানে শেখানো হয় নজরুলের বিভিন্ন গান, যেমন_কাব্যগীতি, রাগাশ্রিত, ভজন, কীর্তন, ইসলামী গান ইত্যাদি থেকে নির্বাচিত কিছু গান; কিন্তু নজরুল কিভাবে গান লিখতেন, কী প্রয়োজনে লিখতেন, কিভাবে সুর সংগ্রহ করতেন, বিশেষ করে নজরুল যে যে সংগীতাঞ্চল থেকে সুর টেনেছেন, সেই আঙ্গিকগুলো সরাসরি এখানে অন্তর্ভুক্ত কি না। অর্থাৎ নজরুলের সৃষ্টি ও কর্মপরিধি নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে চর্চার প্রসঙ্গ আসে কি না। যেমন_নজরুল চলচ্চিত্রের জন্য গান লিখতেন, এইচএমভিতে বাণিজ্যিকভাবে গান লিখতেন, সুর করতেন। বর্তমানে সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এ-জাতীয় প্রচেষ্টা আছে কি না। নজরুল নিয়ে বিভাগ মানে তাঁর সংগীত শেখানোর পাশাপাশি আদর্শ অনুশীলনের একটা পর্ব থাকা বাঞ্ছনীয়। নজরুলসংগীত শেখা যেমন জরুরি, তাঁর সৃষ্টির প্রেষণা ও প্রেক্ষাপটকে উপলব্ধি করে নতুন গানের মান বিবেচনা করা ততোধিক জরুরি। কিন্তু খোদ নজরুলপ্রেমীদের বরাবরই সৃষ্টির প্রতি উন্নাসিকতার কারণে সৃষ্টিশীল শিক্ষার্থীরা নজরুলসংগীতের শিক্ষকের কাছে প্রশিক্ষণ নেয় না।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে বলি, আমি নিজেই সংগীত রচনার শুরুর দিকে আইডল হিসেবে নজরুলসংগীত শিখতে গিয়েছিলাম। সেখানে নিজের সৃষ্টিকর্ম নিয়ে কথা বলায় নানা ধরনের হেঁয়ালি ও তিরস্কারের মুখে পড়তে হয়েছিল। ভালো কিছু সৃষ্টির জন্য পূর্বজ প্রতিভার প্রভাব প্রয়োজন হয়। গ্যেটের ওপর যেমন ছিল ক্রিস্টোফার মার্লো প্রভাব, রবীন্দ্রনাথের ওপর ছিল লালন ও সূফী কবিদের প্রভাব, নজরুলের জন্য ছিল রবীন্দ্রনাথ, খৈয়াম। প্রতিষ্ঠান অবশ্য এসব প্রভাবের শিক্ষা দেয় না; তবে সমর্থনমূলক মানসিকতার দীক্ষা দেয়। নজরুল রুটি বানাতেন বলে শিক্ষার্থীকে রুটি বানানো শেখাতে হবে, এমন কথা বলা হচ্ছে না এখানে; বরং রুটি বানানোর জীবন-বাস্তবতা ও তার মর্ম জানা শিক্ষার্থীর জন্য অত্যাবশ্যক, যা আমাদের নেই। কারণ কিছুসংখ্যক গুরুজনের মনোভাব হলো, নজরুলের মতো এত বড় প্রতিভারই ঠিক মূল্যায়ন হচ্ছে না, তরুণ গীতিকার আবার কে! আর করবেই বা কী!
এটা বিবেচনা করতে হলে কবিতা ও চিত্রকলার দিকে তাকানো যেতে পারে। চিত্ররসিকরা সব সময় পূর্বজ চিত্রকরের চিত্র দেয়ালে টাঙিয়ে সারা দিন বসে তাঁর দিকে তাকিয়ে দেখে রসোপলব্ধি করে আর ভাবে যে এই শিল্পের চেয়ে ভালো তো আর আঁকতে পারব না, তাহলে এঁকে লাভ কী? অথবা কোনো বড় শিল্পীর আঁকা জনপ্রিয় ছবির অনুকরণে একই ছবি যুগ যুগ ধরে আঁকে কি? কবিদের ক্ষেত্রেও কি একই ব্যাপার? সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বলতে যেমন ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ বা চারুকলা বিভাগগুলো কি শুধু পুরনো চিত্রকলার রসতত্ত্বই শেখায়, না নতুন নতুন চিত্র অনুশীলনের তাগিদ দেয়। চারুকলায় তো নতুন সৃষ্টির দক্ষতাই শিক্ষার প্রধান বিবেচনা করা হয়; শুধু জয়নুল-সুলতান-পিকাসোর চিত্রের নান্দনিকতা নিয়েই পড়ে থাকে না। বিশ্বের চিত্রকলার নতুন নতুন দর্শন, তত্ত্ব ও ফর্ম আমদানি করে আন্তর্জাতিক মাত্রা স্থাপন করে। কবিরাও তা-ই করে, কোন দেশে কোন কবিতায় নতুন চিন্তার উদয় হলো, পাল্টাল ভাষার কাঠামো, এগুলো নিয়ে প্রতিনিয়ত গবেষণা চলে। নাটকে, চলচ্চিত্রে, উপন্যাসেও চলে। শুধু ব্যতিক্রম হলো সংগীত। ঢালাওভাবে না বললেও অন্তত প্রাতিষ্ঠানিক চর্চায়। এ দেশে নজরুল বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে, বিভিন্ন সংগীত একাডেমীতে নজরুলসংগীত বিভাগ রয়েছে_কোথাও কোনো সৃজনশীল সংগীতের আশ্রয় নেই। ফলে ডিজিটাল যুগে কম্পিউটারের আশ্রয়ে যারা নজরুলসংগীত করবে, তাদের মাথার ওপর খড়্গ থাকায় নিজস্ব পরিকল্পনায় নজরুলগীতি করতে পারে না।
তবে হ্যাঁ, সুরের বিকৃতির বিষয়ে সবারই আপত্তি আছে। কিন্তু নজরুলসংগীত বলতে কি শুধু তাঁর নির্ধারিত বাণী বা সুরের কাঠামোটাই? এর সঙ্গে কি অন্যান্য সুরযন্ত্র-তালযন্ত্রের প্রয়োগ নেই? সে ক্ষেত্রে কম্পোজিশনের দায়িত্ব নেবে কে? বাজার থেকে হায়ার করা যন্ত্রী এসে বাজিয়ে দিয়ে যাবে? যদি সংগীতশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পাঠদান ও সিলেবাসে সৃজনশীলতার আশ্রয় থাকত, তাহলে কেউ গাইত, কেউ বাজাত, কেউ বা মার্কেটিং করত। প্রতিষ্ঠানের ধর্ম তো সার্বিকভাবে প্রস্তুত করে দেওয়া, প্রাতিষ্ঠানিকভাবে শেখা শিল্পীরা তাদের কর্মযজ্ঞে নামলে তখনই অপ্রাতিষ্ঠানিক যন্ত্রী, রেকর্ডিস্ট, সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারের দ্বারস্থ হতে হয়।
এ কেমন দুর্ভাগ্যময় শিক্ষা? তবে যদি জানা যেত এসব পরিকল্পনার আওতায় রয়েছে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের, শুধু প্রতিকূলতায় বাস্তবায়িত হচ্ছে না; তাহলেও শান্তি পাওয়া যেত। কিন্তু বাস্তব হলো, এসব বিষয়ে কোনো পরিকল্পনামূলক নকশাও তৈরি করতে দেখা যায়নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের কথাই ধরা যাক, এখানে নজরুলসংগীত বিভাগ আছে, কিন্তু কোনো রেকর্ডিং স্টুডিও নেই, সংগীত-প্রযুক্তি ও অডিও রেকর্ডিং নিয়ে কোনো অধ্যায় নেই, গানের তাল-সুর সংগীতের জন্য কোনো বাদ্যযন্ত্র বিভাগ নেই, তবলা প্রশিক্ষকদের বাদনে সহযোগিতা ছাড়া ছাত্রদের স্ব-উদ্যোগে পরিবেশনের কোনো দক্ষতা নেই, আর সংগীতের অভ্যন্তরীণ মেলোডি, কাউন্টার মেলোডি বাজানোর ব্যাকরণ সম্পর্কে বা কম্পোজিশন সম্পর্কে ব্যবহারিক কোনো ধারণা পাওয়ার সুযোগও নেই।
এই উদাহরণ কোনো বিষোদ্গার অর্থে করা হচ্ছে না, কোনো অভিযোগও নয়; এটা পরিস্থিতি, এটা বিশেষজ্ঞ মহলের চিন্তার সীমাবদ্ধতা। এ দেশের সংগীত একাডেমীর প্রতিটি ক্ষেত্রেই এমন দুরবস্থা। ফলে যতই জন্ম-মৃত্যু উৎসব হোক, যতই গ্রামোফোন রেকর্ড সংরক্ষণ করা হোক, স্বরলিপি করা হোক, যতই শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান হোক, সংগীত শিক্ষা ব্যবস্থায় মৌলিক কিছু পরিবর্তন ছাড়া নজরুলের গানের সম্প্রসারণ হবে না। সম্প্রসারণের জন্য সৃজনশীল মনোনিবেশ থাকলে অপ্রচলিত গানে তরুণদের আগ্রহ বাড়বে। সুর নিয়ে গবেষণা বা কম্পোজিশনের প্রবণতা বাড়বে। ছাত্রছাত্রী নতুনত্বের প্রতি গভীর অনুসন্ধানী হয়ে উঠবে।
নজরুলকে নিয়ে প্রতিষ্ঠান না হলেও ঘরে ঘরে নজরুলের চর্চায় ক্ষান্তি দিত না কেউ। এত দিনের অবহেলিত বাকরুদ্ধ নজরুলকে তাঁর যথাযোগ্য আসনে বসিয়েছে ব্যক্তিজীবনের ভক্তপ্রাণ মানুষই। এখন প্রতিষ্ঠান হয়েছে, ফলে নজরুলের সৃষ্টিকর্ম একটি শুদ্ধ ও শৃঙ্খলায় এসে পর্যবসিত হবে_এটাই প্রত্যাশা। তবে শৃঙ্খলার নামে শৃঙ্খলিত করার অভিযোগও কম ওঠেনি। প্রতিষ্ঠানের একটি প্রাতিষ্ঠানিক মনোভাব থাকবেই, সেখানে নজরুলকেও কোনো ব্যক্তি হিসেবে দেখার অবকাশ থাকবে না। একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে দেখতে হবে। সেখানে নজরুলের সহযোগী, অনুসারী-অনুচর, বন্ধু-শত্রু, সুরকার, গায়ক-গবেষক_প্রত্যেকের অবদান সংশ্লিষ্ট থাকা বাঞ্ছনীয়। নজরুলকে প্রকৃত শ্রদ্ধা করতে হলে এত এত বাজেট করে অনুষ্ঠান করার দরকার হয় না। নজরুলের চেতনা, সময় ও দ্রোহের সঙ্গে রাজনৈতিক বিশ্ববীক্ষণকে উপলব্ধি করতে পারলে আজকের তরুণ সমাজের সামনে অবক্ষয়-অন্ধকার দেখা দিত না। নজরুলসংগীত শেখানোর আগে তাঁর জীবন ও সাহসের সার্বিক ধারণা প্রতিষ্ঠা করা আবশ্যক। তাঁর অন্বেষার ছুটন্ত ঘোড়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে, আর আমরা গাইছি প্রেমগীত। বাজারের সস্তা কাঁচামাল হিসেবে গানগুলো ফেরি করছি। এ বড় অন্যায়।
সূত্র: কালের কন্ঠ : শিলালিপি ২১.০৫.২০১০
No comments:
Post a Comment